তিন দশকেরও বেশি আগে যখন এমিরেটস এয়ারলাইনস কেবলমাত্র একটি নবজাত প্রতিষ্ঠান তখনই তার যাত্রায় যুক্ত হন একজন নির্ভীক স্বপ্নদ্রষ্টা বুত্রোস বুত্রোস। ১৯৯১ সালে তিনি এমিরেটসে যোগ দেন যখন এই সংস্থার বহরে মাত্র সাতটি বিমান এবং ১১টি গন্তব্য ছিল। সে সময় খুব কম লোকই কল্পনা করতে পেরেছিল যে এই বিমান সংস্থা একদিন বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক এয়ারলাইনে পরিণত হবে।
আজ সেই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে এমিরেটস। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই প্রতিষ্ঠানটি ২১ বিলিয়ন দিরহাম বা ৫.৮ বিলিয়ন ডলার মুনাফার ঘোষণা দিয়েছে। যা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং বৈশ্বিক বিমান শিল্পের জন্য এক নতুন মাইলফলক।
বুত্রোসের এই অসাধারণ যাত্রার শুরু হয় সাংবাদিক হিসেবে ১৯৮৯ সালে যখন তিনি প্রথমবারের মতো দুবাই আসেন একটি এয়ারশো কভার করতে। তখনই তিনি এই শহরের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনুধাবন করেন। যুক্তরাজ্যে তার প্রতিষ্ঠিত পেশাকে পেছনে ফেলে সাহসের সঙ্গে তিনি পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এমিরেটসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি সবসময় বলি আমি দুবাই ও এমিরেটসের ভিশনে বিশ্বাসী।”
যে বিভাগে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন সেটিই সময়ের পরিক্রমায় এমিরেটসের করপোরেট কমিউনিকেশন, মার্কেটিং ও ব্র্যান্ড বিভাগে রূপ নেয়। এই বিভাগের নেতৃত্বে থেকেই শুরু হয় এমিরেটসের বৈশ্বিক ক্যাম্পেইনের যাত্রা বিশ্ববিখ্যাত তারকাদের সঙ্গে বিজ্ঞাপন এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে বিস্তৃত স্পন্সরশিপ কার্যক্রম যা প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড পরিচিতিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
খালিজ টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্মরণ করেন, “তখন কেউ আমাদের গুরুত্ব দিত না। সবাই ভাবত আমরা শুধু টাকার জোরে চলছি। কিন্তু আমি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রমাণ করছি দুবাইয়ের কাছে তেল নেই তাই এটিকে তেলের টাকা বলা বন্ধ করা উচিত।”

১৯৯২ সালে এমিরেটস প্রথম এয়ারলাইন হিসেবে প্রতিটি আসনে ইন-ফ্লাইট স্ক্রিন চালু করে এমনকি ইকোনমি ক্লাসেও যা তখন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। সেই যুগান্তকারী পদক্ষেপটি ভবিষ্যতের বিমানযাত্রার নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে।
প্রতিষ্ঠানের শুরুতে শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম মাত্র একবার ১০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেন এবং স্পষ্টভাবে বলেন, “এটাই তোমাদের টাকা পরে আর চাইতে এসো না।” এই একটি সাহসী সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে দেয় কীভাবে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্ব একটি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বসেরা করে তুলতে পারে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এমিরেটসের করপূর্ব মুনাফা দাঁড়ায় ২১.২ বিলিয়ন দিরহামে যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। সংস্থার মোট আয় ১২৭.৯ বিলিয়ন দিরহামে পৌঁছেছে যা প্রায় ৩৪.৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এমিরেটসের নগদ সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৪৯.৭ বিলিয়ন দিরহামে অর্থাৎ ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার যা ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। এই সাফল্য এসেছে এমন এক সময়ে যখন বৈশ্বিক মহামারি বিমান চলাচলকে সবচেয়ে বড় সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটে শেখ মোহাম্মদ বলেন, “এমিরেটস শুধু একটি পরিবহন সংস্থা নয় এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক রূপান্তরের হাতিয়ার এবং বিশ্বব্যাপী সংযোগের এক কৌশলগত সেতু।”
এমিরেটস কেবল একটি বিমান সংস্থা নয় এটি এক অনন্য যাত্রার অভিজ্ঞতার প্রতীক। বিনামূল্যে ইন-ফ্লাইট বিনোদন, দক্ষ কেবিন ক্রু এবং বিশ্বমানের কল সেন্টার সবকিছুই যাত্রীদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।
এমিরেটসের নাম আজ জড়িয়ে আছে ক্রীড়াঙ্গনের নানান প্রান্তে। প্রথমে চেলসি ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে শুরু হওয়া যাত্রা এখন বিস্তৃত রাগবি, ক্রিকেট, টেনিস, হর্স রেসিং, ফুটবল এবং এনবিএ পর্যন্ত। প্রতিষ্ঠানটি তাদের মার্কেটিং বাজেটের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যয় করে ক্রীড়াক্ষেত্রেই।
বিজ্ঞাপনেও এমিরেটসের উদ্ভাবনী মনোভাব পরিস্ফুট হয়েছে। পেনেলোপে ক্রুজ, ক্রিস হেমসওয়ার্থ এবং জেনিফার অ্যানিস্টনের মতো তারকাদের নিয়ে তৈরি ক্যাম্পেইনগুলো প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ডকে বিশ্বজুড়ে পৌঁছে দিয়েছে। অ্যানিস্টনকে নিয়ে নির্মিত একটি বিজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করে ১৫০ মিলিয়ন ডলার যেখানে প্রোডাকশন খরচ ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার।
তবে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে বুর্জ খলিফার চূড়ায় নির্মিত একটি বিশেষ বিজ্ঞাপন যেখানে একজন কেবিন ক্রু ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। এক্সপো ২০২০ দুবাইয়ের প্রচারণার জন্য মাত্র ৬০ হাজার দিরহাম বাজেটে নির্মিত এই ভিডিও পরবর্তীতে বিশাল পরিসরের বাণিজ্যিক ক্যাম্পেইনে পরিণত হয় এবং এখন পর্যন্ত এর ভিউ সংখ্যা ৩০ কোটির কাছাকাছি।
বর্তমানে এমিরেটস ১৫০টিরও বেশি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দুবাই ছিল বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক ভ্রমণকৃত শহর। একই বছরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো, ট্রিপ অ্যাডভাইজারের ট্রাভেলার্স চয়েস অ্যাওয়ার্ডসে দুবাই ছিল বিশ্বসেরা গন্তব্য।
এই উত্থান কেবল একটি কোম্পানির আর্থিক সাফল্যের গল্প নয় বরং এটি নেতৃত্ব, উদ্ভাবন এবং নিরবিচারে পরিশ্রমের এক বিরল দৃষ্টান্ত। আর এই গল্পের নেপথ্য নায়ক হচ্ছেন বুত্রোস বুত্রোস একজন নির্ভীক স্বপ্নদ্রষ্টা। যিনি নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন এক বৈশ্বিক পরিচয়।
আজ এমিরেটস যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা ডেল্টা এয়ার লাইন্সকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক এয়ারলাইনে পরিণত হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এমিরেটস গ্রুপ ৬.২ বিলিয়ন ডলার লাভ করেছে যার মধ্যে ৫.৮ বিলিয়ন ডলার এসেছে কেবল এয়ারলাইনের দিক থেকে। আগের অর্থবছরে এই লাভ ছিল যথাক্রমে ৫.২ ও ৪.৭ বিলিয়ন ডলার। ১৪.৯ শতাংশ লাভের এই হার অন্যান্য এয়ারলাইনের জন্য এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪.৯ বিলিয়ন ডলারে যা ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। যাত্রী সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৩.৭ মিলিয়ন, এবং পরিবহন সক্ষমতা ৬০ বিলিয়ন ATKM-এ পৌঁছেছে। যদিও লোড ফ্যাক্টর কিছুটা কমে ৭৮.৯ শতাংশে নেমেছে, প্রতি যাত্রী প্রতি রাজস্ব ১০ সেন্টেই স্থির রয়েছে।
পরিচালন ব্যয় ৪ শতাংশ বাড়লেও, জ্বালানির খরচ একই হারে কমে গেছে। কর্মী সংখ্যা ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ২২৩ জন। কর্মীদের উৎসাহ দিতে প্রতিষ্ঠানটি দিয়েছে ২২ সপ্তাহের সমপরিমাণ বোনাস। গ্রুপের হাতে বর্তমানে আছে ১৪.৬ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড নগদ মজুদ।
এমিরেটস গ্রুপের সিইও শেখ আহমেদ বিন সাইদ আল মাকতুম জানিয়েছেন, গ্রুপ এবার আয়, লাভ ও নগদ সম্পদের দিক থেকে নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, “দক্ষ কর্মীবল, বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব এবং সেরা পণ্য ও পরিষেবা দিয়ে আমরা বাজার চাহিদার সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি।”
আগামী বছর গ্রুপের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে যুক্ত হবে ১৬টি A350 এবং ৪টি বোয়িং ৭৭৭ ফ্রেইটার বিমান। রিট্রোফিট প্রোগ্রামের মাধ্যমে A380, ৭৭৭ এবং A350 বিমানে যাত্রীদের জন্য আরও উন্নত অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ চলছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমিরেটসের এই সাফল্যের পেছনে তাদের মালিকানা কাঠামো ও সরকারের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সরকারি মালিকানার ফলে এমিরেটস কম খরচে অর্থায়নের সুবিধা পায়। বিমানবন্দর, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও ক্যাটারিং খাতেও একক মালিকানার ফলে পরিচালন ব্যয় কমে এসেছে।
যদিও অতীতে গাল্ফ ক্যারিয়ারদের বিরুদ্ধে ভর্তুকি গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল, এখন এমিরেটস আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন মান (IFRS) অনুযায়ী তাদের আর্থিক প্রতিবেদন স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারলাইনগুলো সাধারণত ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার প্রোগ্রাম ও কো-ব্র্যান্ডেড কার্ড থেকে বেশি আয় করে কারণ যাত্রী পরিবহন থেকে লাভ করা তাদের জন্য কঠিন। এমিরেটস বড় বিমানের মাধ্যমে বেশি যাত্রী পরিবহন করে ব্যয় কমিয়ে ফেলতে পেরেছে।
বিশ্বে অনেক এয়ারলাইন যেখানে A380 পরিচালনায় সংকটে পড়েছে এমিরেটস সেখানে এটিকে সফলভাবে ব্যবহার করে নিজেদের লাভের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। যদিও ২০৩০-এর দশকে A380 ধীরে ধীরে অবসরে যাবে, সেই শূন্যতা পূরণই ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
সব মিলিয়ে এমিরেটসের এই রেকর্ড সাফল্য প্রতিষ্ঠানটির জন্য একটি ঐতিহাসিক অর্জন। টানা তৃতীয় বছরের মতো সর্বোচ্চ লাভ অর্জন করে তারা কেবল একটি ব্যবসার মডেল নয় বরং নেতৃত্ব, উদ্ভাবন ও সাহসী পরিকল্পনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিশ্ববাণিজ্যের আকাশে এমিরেটস এখন এক নির্ভরযোগ্য নাম যার পেছনে রয়েছেন একজন দূরদর্শী নেতা বুত্রোস বুত্রোস।

