বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জনসংখ্যার বড় একটি অংশ তরুণ—যা আমাদের জন্য একদিকে সম্ভাবনা, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ। কারণ এই বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহু মানুষ কর্মক্ষম হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, বাড়ছে হতাশাও। বাংলাদেশ আজ তারুণ্যের দেশ।
দেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ—প্রায় ৬০ শতাংশ—৩৫ বছরের নিচে। এটি যেমন আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ, তেমনি একটি চ্যালেঞ্জও। কারণ এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করা না গেলে, আমাদের উন্নয়নযাত্রা বাঁধাগ্রস্ত হবে। তাই এখন আর কেবল বেকারত্বের অভিযোগ নয়, প্রয়োজন বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘস্থায়ী কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখা এবং বাস্তবায়নের সাহসী পদক্ষেপ।
“বেকারত্ব নয়, কর্মসংস্থানের স্বপ্ন খুঁজি”– এই স্লোগানটি বর্তমান তরুণ সমাজের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বার্তা। এটি কেবল বেকারত্বের সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসে না, বরং এর সমাধানে যে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার প্রয়োজন সেটিও স্পষ্ট করে তোলে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর চাকরির আশায় বছরের পর বছর অপেক্ষা করেন। প্রতিযোগিতা যেমন তীব্র, তেমনি উপযুক্ত চাকরি পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় অনেকের মধ্যেই হতাশা তৈরি হচ্ছে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে অনেকেই।
এই অবস্থার পরিবর্তনে দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আমাদের বুঝতে হবে শুধু চাকরি পাওয়াই লক্ষ্য নয়—বরং নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করাই আজকের সময়ের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জ। কর্মসংস্থান মানে শুধু একটি চাকরি নয়, এটি হতে পারে একটি নিজস্ব উদ্যোগ, একটি ছোট ব্যবসা, বা এমন কোনো কাজ যা সমাজে মূল্য যোগ করে এবং অন্যদেরও উপকার করে।
এই স্লোগানটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, তরুণদের শুধু চাকরির পেছনে ছোটার পরিবর্তে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে আগ্রহী হতে হবে। নতুন কিছু করার সাহস থাকতে হবে, নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে। নিজে কিছু শুরু করলে, অন্যদের জন্যও কাজের সুযোগ তৈরি হবে। তাতে সমাজ উপকৃত হবে, দেশও এগিয়ে যাবে।
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিনির্ভর কাজ, গিগ-ইকোনমি, ফ্রিল্যান্সিং, উদ্যোক্তা উদ্যোগ এবং দক্ষতাভিত্তিক কাজের যে নতুন পরিবেশ গড়ে উঠছে—তার পুরো সুযোগ নিতে পারলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম শুধু নিজেদের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও হতে পারে নতুন আলোর দিশারি।
বেকারত্বের বর্তমান চিত্র: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মাঝেও বেকারত্ব আজ এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে দেশে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর (দ্বিতীয় প্রান্তিক) সময়ে দেশের বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ—যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি। গত বছর একই সময়ে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বর্তমানে দেশে আনুমানিক ২৭ লাখ মানুষ বেকার, যার মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ এবং ৮ লাখ ৩০ হাজার নারী। শুধু এক বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার। ২০২৩ সালে যেখানে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৫০ হাজার, আর ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে।
এছাড়াও শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারেও নেমে এসেছে উল্লেখযোগ্য ভাটার টান। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৪১ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এই হার ছিল ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ। পুরো বছরের হিসেবে ২০২৪ সালে গড় শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের ৫০ দশমিক ৯২ শতাংশ-এর তুলনায় কম।
বিবিএস-এর সর্বশেষ জরিপ বলছে দেশের মোট শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ৮৯ লাখ, যার মধ্যে ৫ কোটি ৬২ লাখের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যাও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার। এদের বড় একটি অংশই উচ্চশিক্ষিত, বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার জাতীয় গড় হারের চেয়ে অনেক বেশি।
উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতি ১০০ জন বেকারের মধ্যে ২৮ জনই বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ বা তরুণী। এর মানে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের যোগসূত্রে ঘাটতি রয়েছে। এই চিত্র স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যে, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নতুন ধরনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। কেবল শিক্ষাগত ডিগ্রি দিয়ে চাকরি মিলছে না; প্রয়োজন বাজার উপযোগী দক্ষতা, প্রযুক্তিজ্ঞান, উদ্যোক্তা মনোভাব এবং একটি নতুন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি।
শিক্ষার সাথে কর্মসংস্থানের বৈষম্য: বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত সমস্যাগুলোর একটি হলো—শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব। একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘ সময় ও শ্রম ব্যয় করে ডিগ্রি অর্জন করলেও বাস্তবে সে কর্মজীবনে প্রবেশের সময় নানা রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। তার কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও এমনভাবে সাজানো হয়নি, যা সরাসরি কর্মসংস্থানের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া অনেক তরুণ-তরুণীকে দেখা যায় অল্প বেতনের কাজ বা সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতের চাকরির জন্য লড়াই করতে। অনেকেই বাধ্য হন কল সেন্টারে বা মার্কেটিং সেক্টরে ঢুকে পড়তে—যেখানে তাদের অর্জিত বিদ্যার কোনো প্রয়োগ নেই। এই অবস্থার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কাঠামোগত এবং নীতিগত দুর্বলতা।
প্রথমতঃ আমাদের পাঠ্যক্রম এখনও মূলতঃ তাত্ত্বিক জ্ঞানকেন্দ্রিক। বাস্তব জীবন ও কর্মক্ষেত্রের প্রয়োগযোগ্য দক্ষতা শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খুব কমই অর্জন করতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি, সফট স্কিল, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি—এসব বিষয়ে শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেক পিছিয়ে।
দ্বিতীয়ত: দেশে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে ধীর গতিতে। জনসংখ্যার তুলনায় নতুন শিল্প, উদ্যোক্তা বা সেবা খাতে চাকরির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী বের হলেও, উপযুক্ত চাকরির অভাবে অনেকেই বেকার থেকে যাচ্ছেন।
তৃতীয়ত: দক্ষতার ঘাটতি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল সার্টিফিকেট থাকলেই চলবে না—এখনকার চাকরিদাতারা ব্যবহারিক দক্ষতা, কমিউনিকেশন স্কিল, আইটি জ্ঞান এবং প্রফেশনালিজমকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই দিকগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি না হওয়ায় কর্মসংস্থানে তারা পিছিয়ে পড়ছে।
চতুর্থতঃ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় দেখা যায় স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি বা পক্ষপাতিত্বের কারণে যোগ্যরাও বাদ পড়ে যান। এতে শুধু ব্যক্তি নয়, দেশেরও মেধা ও দক্ষতা ক্ষয় হয়।
পরিশেষে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের পার্থক্যও কর্মসংস্থানে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের মতো সুযোগ-সুবিধা পান না, ফলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকেন। এই বৈষম্য দূর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, দক্ষতা উন্নয়নমুখী শিক্ষা চালু, প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা খুব জরুরি। তাহলেই শিক্ষার সত্যিকারের মান ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে।
ভবিষ্যৎ দিক-নির্দেশনায় কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত:বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থান শুধু জীবিকা অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের জীবনের মানোন্নয়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ধরন ও চ্যালেঞ্জ বদলে যাচ্ছে। তাই এখন প্রয়োজন ভবিষ্যতমুখী পরিকল্পনা ও বাস্তবমুখী দিকনির্দেশনা গ্রহণ।
বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষিত যুব সমাজের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু তাদের বড় একটি অংশই কর্মসংস্থানের বাইরে রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে দক্ষতা উন্নয়ন। বর্তমান চাকরির বাজারে শুধু সার্টিফিকেট থাকলেই চলবে না, বরং প্রয়োজন প্রযুক্তি, কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় তথ্যপ্রযুক্তি, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং কিংবা অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং-এর মতো খাতে দক্ষতা অর্জন করে দেশে-বিদেশে আয় করা সম্ভব হচ্ছে। তরুণদের এসব খাতে আগ্রহী ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
আত্মকর্মসংস্থানও এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। অনেকেই চাকরির অপেক্ষায় বসে না থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ বেছে নিচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) খাতে নতুন নতুন ব্যবসা, স্টার্টআপ কিংবা সামাজিক উদ্যোগ তরুণদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে পারে। তবে এর জন্য সহজ শর্তে ঋণ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং নীতিগত সহায়তা জরুরি।
শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও কর্মসংস্থানের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করা দরকার। কৃষি খাতকে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে উন্নয়ন করা গেলে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব। পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি, হস্তশিল্প, মাছচাষ, দুগ্ধ খামার ও পরিবেশবান্ধব ট্যুরিজম সেক্টরেও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বেসরকারি খাতেও কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ রয়েছে, তবে এই খাতকে আরও বিস্তৃত ও সংগঠিত করতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করা গেলে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে, ফলে কর্মসংস্থানও বাড়বে।
এছাড়া শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং কাজের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যারা ইতোমধ্যেই কাজে নিযুক্ত রয়েছেন তাদের চাকরির নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি, প্রশিক্ষণের সুযোগ ও পেশাগত বিকাশ নিশ্চিত করলে কর্মসংস্থান আরও টেকসই হবে।
ভবিষ্যতে প্রযুক্তিনির্ভর চাকরি আরও বাড়বে যার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও গ্রিন টেকনোলজি অন্যতম। এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন করতে পারলে বাংলাদেশি তরুণরা শুধু দেশেই নয়, বিশ্ববাজারেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারবেন।
এই জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জন। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে এসব উদ্যোগকে আরও বাস্তবমুখী, সহজলভ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলতে হবে যেন গ্রামীণ ও পিছিয়ে পড়া তরুণরাও এতে অংশ নিতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা মনোভাব ও মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আমাদের ভাবতে হবে—চাকরি না পেলে আমি কী করতে পারি, বরং কী তৈরি করতে পারি। নিজের জন্য কীভাবে একটুকু কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তা নিয়েই ভাবা উচিত।
আশার আলো: করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। একসময় যে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক আমাদের ঘিরে রেখেছিল, আজ তা অনেকটাই পেছনে ফেলে আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি। রেমিট্যান্স, তৈরি পোশাক খাত এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অভাবনীয় অগ্রগতি আমাদের নতুন করে আশাবাদী করে তুলছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে প্রবাসী আয়ে বড় রকমের পুনরুদ্ধার দেখা গেছে। বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ধারা আবারও আশাজাগানিয়া গতিতে এগোচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার, যা এক মাসের মধ্যে রেমিট্যান্স গ্রহণের একটি রেকর্ড। আগের বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় এটি প্রায় ৩৩ শতাংশ বেশি, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত।
এই ধারা অব্যাহত রেখে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে হিসাব করলে, এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৩ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৯ কোটি ১৭ লাখ ডলার করে দেশে আসছে রেমিট্যান্স—যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখছে এবং অর্থনীতিতে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিচ্ছে। প্রবাসীদের এই অবদান আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ যদি এভাবে অব্যাহত থাকে তবে এটি দেশের কর্মসংস্থান, উন্নয়ন খাত এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আরও বড় অবদান রাখবে।
একই সঙ্গে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতেও ধীরে ধীরে ইতিবাচক গতি ফিরে আসছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেলেও উদ্যোক্তারা এখন নতুন বাজার যেমন: চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। ফলে শ্রমনির্ভর এই খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতেও বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। তরুণ ফ্রিল্যান্সার ও আইটি উদ্যোক্তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং জাতি। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য একটি সম্ভাবনাময় কর্মক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠছে।
এসব ইতিবাচক দিকের সঙ্গে যদি সরকার, বেসরকারি খাত এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা হয় তাহলে আরও অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। দরকার কেবল সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং নতুন শিল্প ও সেবার ক্ষেত্র উদ্ভাবন।
যদি আমরা পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাই, তবে বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে এক নতুন অর্থনৈতিক দিগন্তের উন্মোচন সম্ভব। এই অগ্রযাত্রায় ‘আশার আলো’ হয়ে জ্বলবে আমাদের সম্ভাবনার প্রদীপ।
“বেকারত্ব নয়, কর্মসংস্থানের স্বপ্ন খুঁজি”—এই স্লোগান শুধু একটি কথা নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি আহ্বান।এটি আমাদের শেখায় কীভাবে সমস্যা থেকে সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে, তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দৃষ্টিভঙ্গিই হতে পারে একটি নতুন বাংলাদেশের ভিত, তরুণরাই হবে কর্মসংস্থানের নির্মাতা, কেবল চাকরিপ্রার্থী নয়।
সবশেষে বলা যায় কর্মসংস্থান একটি সম্মিলিত উদ্যোগের বিষয়। সরকারের নীতিগত সহায়তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, বেসরকারি খাতের উদার অংশগ্রহণ এবং তরুণদের মনোভাবের পরিবর্তন—এই চারটি দিক একত্রে কাজ করলেই টেকসই কর্মসংস্থানের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে।