দীর্ঘ কয়েক বছর টানা অস্থিরতা আর মূল্যবৃদ্ধির পর অবশেষে দেশের সবজির বাজারে ফিরেছে স্বস্তি। আর সেই স্থিতিশীলতার সুফল এবার মিলেছে আন্তর্জাতিক বাজারেও—২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের সবজি রপ্তানি বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি!
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, সদ্যসমাপ্ত বছরে সমুদ্রপথে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার ৭৬৬ মেট্রিক টন সবজি, যেখানে আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ১৪ হাজার ২০২ টন। অর্থাৎ, এক বছরে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩১৩ শতাংশ—যা নিঃসন্দেহে এই খাতে এক বড় সাফল্যের ইঙ্গিত।
সব রপ্তানিকৃত সবজির মধ্যে আলুর অবস্থান শীর্ষে। সমুদ্রপথে রপ্তানি হওয়া সবজির মধ্যে ৪০ হাজার ৫৪৩ টন-ই ছিল আলু। এরপরে রয়েছে তাজা সবজি (১৬ হাজার ৯৫৯ টন) এবং হিমায়িত সবজি (১ হাজার ২৬৪ টন)।
যেখানে একসময় বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার টন আলু রপ্তানি করত, সেখানে গত কয়েক বছর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সেই পরিমাণ নেমে গিয়েছিল মাত্র কয়েক হাজার টনে। এতে রপ্তানিকারকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে এবার আবারও সেই হারানো আস্থা ফিরে পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম জানান, এবার শুধু সমুদ্রপথেই নয়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়েও প্রায় ২০ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে নেপালে—যেখানে আগে ভারতের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।
তিনি আরও বলেন, “আগে আলুর উচ্চমূল্য রপ্তানির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এখন বাজার স্থিতিশীল হওয়ায় রপ্তানি আবার গতি পেয়েছে। পরিবহন ব্যয়ও মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে।”
তাজা সবজির মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে বাঁধাকপি (১৫,৭০০ টনের বেশি)। এছাড়া ছিল:
- মিষ্টি কুমড়া: ৭০০ টন
- মরিচ: ২৭৯ টন
- টমেটো: ১৬৮ টন
- কচু: ৫৬ টন
- ফুলকপি: ২৩ টন
- অন্যান্য সবজি: প্রায় ২৬ টন
বিশেষ দিক হলো, এসব তাজা সবজি এবার বিমানের বদলে এসি কনটেইনারে করে সমুদ্রপথে পাঠানো সম্ভব হয়েছে, যা পরিবহন খরচ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের সবজি প্রধানত রপ্তানি হয় মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। এসব দেশের প্রবাসী বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশীয় রেস্তোরাঁ হচ্ছে প্রধান ক্রেতা।
অনেক সময় ফ্রোজেন সবজি ইউরোপ ও আফ্রিকাতেও রপ্তানি করা হয় সাধারণ কনটেইনারে করে।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য এলাকা, যশোর, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, মেহেরপুর, রংপুর ও নরসিংদী—এসব অঞ্চল থেকেই রপ্তানির জন্য সবজি সংগ্রহ করা হয়।
চট্টগ্রাম ফ্রেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স গ্রুপের সভাপতি মাহবুব রানা বলেন, “বাজার স্থিতিশীল হওয়ায় রপ্তানি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “বিশেষ করে বিমানপথে পর্যাপ্ত কার্গো স্পেসের অভাব বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ বা আমেরিকায় এক কেজি সবজি পাঠাতে খরচ পড়ে ৬৫০–৭০০ টাকা, অথচ ভারত একই কাজ করে মাত্র ৩০০ টাকারও কমে।”
আরও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকারি ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমছে, এবং ২০২৬ সালের মধ্যে তা পুরোপুরি তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মাহবুব রানা মনে করেন, “যদি সরকার রপ্তানিযোগ্য সবজিকে অগ্রাধিকার খাতে পরিণত করে, তাহলে রপ্তানির পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। আমাদের সামর্থ্য আছে, দরকার কেবল নীতিগত সহায়তা।”
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এই প্রবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে আশার আলো। দীর্ঘ অস্থিরতার পর নতুন করে গতি পাওয়া এই খাত যদি সঠিক পরিকল্পনা ও সহায়তা পায়, তবে সবজি রপ্তানি হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। দেশজ উৎপাদন আর বৈশ্বিক বাজার—এই দুইয়ের মেলবন্ধনে এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার।

