ভরসার বিমা এখনো অনেক গ্রাহকের কাছে আস্থা তৈরি করতে পারছে না। এর যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। দেশের ৪৬টি নন-লাইফ কোম্পানি মিলিয়ে গ্রাহকের দাবির ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আটকে রেখেছে। ডিসেম্বরের শেষে যা ছিল ২ হাজার ৬৩৫ কোটি, মার্চের শেষে সেখানে আরও ৫১৫ কোটি টাকা যোগ হয়েছে। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ অনিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাধারণ বিমায় মোট দাবি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৯৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি ১০০ টাকা দাবির সাড়ে আট টাকার কমই পরিশোধ হয়েছে। বাকি প্রায় ৯১ টাকা গ্রাহকের হাতে পৌঁছায়নি। এই সংখ্যা খাতের বর্তমান আস্থা সংকটের নীরব সাক্ষী।
মাঠের অভিযোগও একই ছবি আঁকে। গ্রাহকরা কাগজপত্রের ঝক্কি, সার্ভে রিপোর্টের জটিলতা, পুনর্বিমার অজুহাত এবং নানা দরজায় ধাক্কা খেয়ে শেষমেষ ক্লান্ত হয়ে যান। কিন্তু দাবি মেলে না। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শীর্ষে রয়েছে সিকদার ইনস্যুরেন্স। কোম্পানির দাবি ছিল ২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা, এর মধ্যে পরিশোধ করেছে মাত্র ৩ লাখ ১৩ হাজার। অর্থাৎ ৯৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ দাবি বকেয়া। দ্বিতীয় অবস্থানে সেনা কল্যাণ ইনস্যুরেন্স, ৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার বিপরীতে দিয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৫০ হাজার। পরিশোধের হার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে নর্দান ইসলামী ইনস্যুরেন্স, ৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকার মধ্যে দিয়েছে ৬ কোটি ৮৭ লাখ, পরিশোধের হার ১ দশমিক ০৬ শতাংশ। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে থাকা স্ট্যান্ডার্ড ইনস্যুরেন্স ও ঢাকা ইনস্যুরেন্স যথাক্রমে ১ দশমিক ৪৪ ও ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাবি পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ দু’টির প্রায় ৯৯ শতাংশ দাবি বকেয়া রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, অধিকাংশ কোম্পানি গ্রাহকের দাবি নগণ্য হারে পরিশোধ করেছে। পিপল ইনস্যুরেন্স দিয়েছে ১ দশমিক ৮২ শতাংশ, ইস্টার্ন ৩ দশমিক ১৬, দেশ জেনারেল ৩ দশমিক ৪৪, এসবিসি ৩ দশমিক ৭৯, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ৪ দশমিক ০১ এবং এশিয়া প্যাসিফিক ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। তুলনামূলক কিছুটা বেশি দিয়েছে পূরবী জেনারেল ৭ দশমিক ০৭, সাউথ এশিয়া ৭ দশমিক ৮০ এবং প্যারামাউন্ট ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় রয়েছে ফনিক্স ৮ দশমিক ৪৬, গ্রিন ডেলটা ৯ দশমিক ৪৭ ও মার্কেন্টাইল ইসলামী ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, দাবি নিষ্পত্তি না হওয়াই খাতের প্রধান সমস্যা। তিনি বলেন, ‘সমস্যা শনাক্ত হয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ তবে বাস্তবতা হলো, বিমার বাজারে যে আস্থা ক্ষয় পেয়েছে, তা শুধু আশ্বাসে পূরণ হয় না। দ্রুত এবং দৃশ্যমান ফলাফল দেখতেই গ্রাহকরা চায়। অন্যদিকে, জনতা ইনস্যুরেন্স দাবি নিষ্পত্তিতে সেরা, এরপর রয়েছে ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স ও প্রাইম ইনস্যুরেন্স। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রমাণ করছে, ইচ্ছা ও সঠিক প্রক্রিয়া থাকলে অর্থ ছাড় সম্ভব। অর্থাৎ খাতের জট শুধু টাকার ঘাটতি নয়; শাসনব্যবস্থা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দায়বদ্ধতার অভাবও সমানভাবে দায়ী।
কোম্পানিগুলোর ব্যাখ্যা এখনও পুরোনো। জানতে চাইলে সিকদার ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রফিক বলেন, ‘৫ আগস্টের কয়েকটি দুর্ঘটনার দাবি সাধারণ বিমা করপোরেশনে আছে। এসবিসি থেকে অর্থ পেলে দেওয়া হবে।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বক্তব্য বাজারের কাঠামোগত দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। রি-ইনস্যুরেন্স বা পুনর্বিমার ধারা সমন্বয়ে ব্যর্থ হলে প্রাইমারি গ্রাহক কেন আটকে থাকবেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের জয়েন্ট সেক্রেটারি এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘দাবি পরিশোধে আইডিআরএ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। গ্রাহককেও প্রস্তুত থাকতে হবে। দাবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে নির্ভুল কাগজপত্র জমা, প্রতিটি যোগাযোগ নথিভুক্ত রাখা, ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে আইডিআরএতে অভিযোগ, প্রয়োজনে বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটিতে আবেদন, তারপরও সমাধান না হলে দ্রুত আদালতের শরণাপন্ন হওয়া—এই ধাপগুলো শৃঙ্খলা হিসেবে পালন করতে হবে।’

