দেশের আর্থিক খাতে কয়েক বছর ধরেই সংকট চলছে। উচ্চ খেলাপি ঋণের চাপের কারণে অন্তত এক ডজন ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী আমানতের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। এ আস্থাহীনতার প্রভাবে অনেক ব্যাংকের আমানত না বেড়ে কমছে। তবে এ অবস্থার মধ্যেও ভালো করছে ব্যাংকের উপশাখা (সাব-ব্রাঞ্চ) মডেল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল-জুনে উপশাখার মাধ্যমে সংগৃহীত আমানতের প্রবৃদ্ধি মূলধারার ব্যাংকিংয়ের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও উপশাখার বৃদ্ধি সার্বিক প্রবৃদ্ধির সাত গুণ। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক উপশাখা ব্যাংকিং নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের সামগ্রিক ব্যাংক খাতে আমানতের বৃদ্ধি ৩.৮ শতাংশ। একই সময়ে উপশাখার আমানত বেড়েছে ১২.৩ শতাংশ। সামগ্রিক ঋণ বৃদ্ধি ১.৩ শতাংশ থাকলেও উপশাখার ক্ষেত্রে তা ৯.৮ শতাংশ।
জনগণের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলোকে উপশাখা চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়। এর এক বছর আগে কিছু ব্যাংক ‘ব্যাংকিং বুথ’ চালু করেছিল। ওই মডেলকে পরে উপশাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট শাখার অধীনে তিন-চারজন কর্মী নিয়ে ছোট পরিসরে উপশাখা চালু করছে। চলতি বছরের জুনে দেশের ৬২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৪৮টি উপশাখা চালু করেছে। এই ব্যাংকগুলোর উপশাখার সংখ্যা ৪ হাজার ৮০০, যার ৪৯ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৮ হাজার ৭১ কোটি টাকা উপশাখার মাধ্যমে সংগ্রহ হয়েছে। আমানত হিসাবের সংখ্যা ৬৭ লাখ ৮১ হাজার ৮৭৪টি। একই সময়ে মোট ঋণ স্থিতি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা উপশাখার মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে। ঋণপ্রাপ্ত ব্যাংক হিসাব ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ৯০৪টি।
উপশাখার মধ্যে সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক চালু করেছে আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসি। এ ব্যাংকের ১ হাজার ২২৫টি উপশাখা রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসি। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং পূবালী ব্যাংক পিএলসি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপশাখা চালু করেছে।
আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘উপশাখার সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ায় লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচলিত শাখা প্রান্তিক এলাকায় পৌঁছতে পারে না। ফলে জনগণের বড় অংশ আনুষ্ঠানিক আর্থিক সুবিধার বাইরে থাকে। কম খরচ ও কম জনবল নিয়ে প্রান্তিক এলাকায় উপশাখা চালু করলে ব্যাংকিং সুবিধা সহজে পৌঁছে যায়। মফস্বল এলাকায় উপশাখা “আনব্যাংকড” জনগণের কাছে ব্যাংকিং পৌঁছে দিচ্ছে। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরাও হিসাব খুলে টাকা জমা রাখছে। প্রবাসী আয়ের টাকাও সহজে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই উপশাখা ভালো করছে। যদি এই সেবা বিস্তৃত করা যায়, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে।’
চলতি বছরের জুনে ব্যাংকগুলোর উপশাখার ২০ শতাংশ ঢাকা জেলায়। ঢাকায় ৯৬৭টি উপশাখা রয়েছে। এছাড়া উপশাখা স্থাপনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, নোয়াখালী, বগুড়া, খুলনা ও টাঙ্গাইল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, উপশাখার ৪৯ শতাংশ গ্রামীণ ও পল্লী এলাকায়। জুনে উপশাখাভিত্তিক আমানতের ৩৩.৭ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায়। মার্চের তুলনায় ০.৭ শতাংশ বেশি। তবে ঋণ বিতরণ কমেছে। মার্চে গ্রামীণ এলাকায় উপশাখার ঋণ অংশীদারত্ব ছিল ৩৫.২ শতাংশ, জুনে নেমে এসেছে ৩৪.৮ শতাংশ। নারী উদ্যোক্তারা উপশাখার মাধ্যমে ১৫.২ শতাংশ ঋণ পেয়েছেন, কিন্তু আমানতের ২৬.৩ শতাংশই নারী দিয়েছেন।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের মূল ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড নগরকেন্দ্রিক। বড় শাখা হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে যা ফেরত আসছে না। ফলে খেলাপি ঋণের হার ২৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। উপশাখা দেশের প্রান্তিক জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের সুযোগ দিচ্ছে। যদি ব্যাংক তা কাজে লাগায়, গ্রামীণ কৃষি ও সিএসএমই খাত বড় ধরনের সুবিধা পাবে।