রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে নতুনবাজার হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত পাতালপথে মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প এমআরটি-১-এর কাজ আবার থেমে গেছে। প্রকল্পটি ১২টি প্যাকেজে ভাগ করে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সিপি-২, সিপি-৫, সিপি-৭, সিপি-৯ ও সিপি-১০ প্যাকেজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ দর দাবি করছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এই অতিরিক্ত অর্থ দিতে রাজি নয়। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয়ের বৃদ্ধি জটিলতা আরও বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-১-এ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১২টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। পাতালপথের দৈর্ঘ্য হবে ১৯.৮৭২ কিলোমিটার, যা নতুনবাজার হয়ে পূর্বাচল রুটে পৌঁছাবে। নতুনবাজার থেকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত ১১.৩৬৯ কিলোমিটার উড়ালপথ নির্মাণ হবে। নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি।
নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জে ডিপো নির্মাণের কাজ সিপি-২ প্যাকেজের আওতায় হচ্ছে। কাজ পেয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো অ্যান্ড করপোরেশন (এসবিসিএল)। ফেব্রুয়ারিতে এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। মে মাসে মেট্রোরেলের মূল পরামর্শক জাইকা খসড়া চুক্তিপত্রে অনাপত্তি জানায়। কিন্তু ঠিকাদার সিনোহাইড্রো এই প্যাকেজে ৩,৩৩০ কোটি টাকা বিল দাবি করেছে, যা প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ।
সিপি-৫ প্যাকেজে ট্রানজিশন সেকশন থেকে নর্দ্দা স্টেশনে পাতালপথ যাবে। দৈর্ঘ্য ৩.৩৯ কিলোমিটার। জাপানের সুমিতুমি মিতসুই করপোরেশন কাজ করছে। প্রকল্প অফিস ৩,৮০০ কোটি টাকা দিতে রাজি হলেও ঠিকাদার ৫,০০০ কোটি টাকার দাবি করেছে। সিপি-৯ ও সিপি-১০ প্যাকেজে ট্র্যাক নির্মাণ, বৈদ্যুতিক পরিষেবা, সিগন্যাল ও টেলিকম সিস্টেম স্থাপন এবং প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর নির্মাণের কাজও জাপান-ভারতের কনসোর্টিয়াম করছে। তবে তারা প্রাক্কলিত ব্যয়ের দ্বিগুণ অর্থ দাবি করেছে।
প্রকল্পের শুরুতেই ঠিকাদারদের অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয় যাকে মোবিলাইজেশন অ্যাডভান্স বিল বলে। এটি শ্রমিক নিয়োগ, যন্ত্রপাতি ও বেসক্যাম্প নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। সিপি-২ ও সিপি-৫ প্যাকেজের ঠিকাদাররা এই বিল না পাওয়ায় কাজ থেমে রেখেছে। এমআরটি-১ প্রকল্প অফিসে জানিয়েছেন, পাতালপথের কাজের জন্য ২০% এবং উড়ালপথের জন্য ১৫% মোবিলাইজেশন অ্যাডভান্স বিল ঠিকাদারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে এমআরটি-১ প্রকল্পের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৮,৬৩১.৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। সরকারের তহবিল থেকে ১,৩২২.৪৫ কোটি, জাইকার ঋণ সহায়তা ৭,৩০৮.৯৮ কোটি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ২ লাখ টাকা। নির্মাণকাজ স্থগিত থাকায় বরাদ্দ অর্থ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। গত অর্থবছরে ১,২৬৮ কোটি টাকা ফেরত গেছে সরকারের তহবিলে। সিপি-১ প্যাকেজের ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩,১৭৬.৯৪ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ৫.৮৯% এবং ভৌত অগ্রগতি ৬.১০%।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ব্যয় দিতে অনিচ্ছুক কারণ রোলিং স্টকের মূল্য খুব বেশি। এমআরটি-৬ প্রকল্পের প্রতিটি কোচের খরচ প্রায় ১০০ কোটি, এমআরটি-১-এ তা দ্বিগুণ হতে পারে। প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৪৯,৫১৫ কোটি টাকা। বর্তমানে চলমান প্যাকেজের দর অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় বেড়ে ৫৯,৫৪৪ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ১,৮৮৭ কোটি টাকা। ৭টি প্যাকেজের ঠিকাদারি দর ও ৪টি প্যাকেজের প্রাথমিক প্রস্তাব বিশ্লেষণ করলে পুরো প্রকল্পের ব্যয় ৭৫,৬৪৯ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। পাতালপথের প্রতি কিলোমিটার টানেল নির্মাণের খরচ ২,৩৯৮ কোটি টাকা হতে পারে।
ডিএমটিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাক্কলিত দর ঠিক করার সময় ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪.৫০ টাকা, এখন ১২০ টাকার ওপর। ডলারের বৃদ্ধি ও প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়ের কারণে ঠিকাদারদের দাবি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ মানতে পারছে না। মোবিলাইজেশন অ্যাডভান্স নিয়ে বোর্ড সভায় মতবিরোধও হয়েছে। ডিএমটিসিএলের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মো. আবদুল বাকী মিয়া ফোনে বলেন, “আমি এমআরটি-ওয়ান নিয়ে কিছু বলতে পারব না।”