বাংলাদেশের চিংড়ি খাত একসময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় শীর্ষ খাত হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে আলোকবর্তিকা হিসেবেই পরিচিত ছিল। তৈরি পোশাকের পরে রপ্তানির দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকতো হিমায়িত চিংড়ি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা সংকটের কারণে এই খাতের অবস্থান চরমভাবে অবনতি হয়েছে। ২০২৫ সালে চিংড়ি খাত এখন রপ্তানি আয়ের শীর্ষ ১০ খাতের তালিকায় ১০ নম্বরে দাঁড়িয়েছে।
চিংড়ি রপ্তানির এই ধসের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালা না মেনে চিংড়িতে অপদ্রব্য ইনজেকশন বা ‘পুশ’ দেওয়ার ঘটনা, উৎপাদন হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চাপ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পোনা সংকট—all মিলিয়ে খাতটির রপ্তানি আয় হ্রাস পাচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের শীর্ষ ১০ রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ, বাকিটা এসেছে অন্যান্য পণ্য থেকে। সেই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, এরপর কৃষি, পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, কটন পণ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, ফুটওয়্যার এবং ১০ নম্বরে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৪৪,২৭৮ টন চিংড়ি, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫১ কোটি ডলার। পরবর্তী ১০ বছরে ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে ২০২৪-২৫ সালে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের চিংড়ি। বর্তমানে ১০৯টি নিবন্ধিত চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যে খুলনায় ২০টি এবং চট্টগ্রামে ১৮টি কার্যক্রম চালু আছে।
বিএফএফইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তরিকুল ইসলাম জহীর বলেন, “একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়ির ভেতরে পুশ দিয়ে ওজন বাড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর প্রভাব পড়ছে, ক্রেতারা বাংলাদেশি চিংড়িতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। এতে রপ্তানি কমছে।”
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার জানিয়েছেন, চিংড়িতে অপদ্রব্য ‘পুশ’ ঠেকাতে অভিযান চলমান। ইতিমধ্যেই কিছু প্রক্রিয়াজাত কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো কারখানা হেডলেস চিংড়ি কিনতে পারবে না; শুধু মাথা-সহ চিংড়ি কেনা যাবে, তারপর প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতে হবে।
তবে খাতের সংকটের একমাত্র কারণ ‘পুশ’ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদী-খাল শুকিয়ে যাচ্ছে, জোয়ার-ভাটায় জমি উঁচু হচ্ছে, উৎপাদন কমছে। সুন্দরবনের আশপাশে মাছ ধরায় বিষ ব্যবহার, অসাধু সিন্ডিকেটের দখল—সব মিলিয়ে উৎপাদন ও রপ্তানি দুই ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়ছে।
সুন্দরবন একাডেমির অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “উৎপাদন কমে যাওয়ার মূল কারণ হল প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি এবং অসাধু চাষি। এটি সমন্বিতভাবে ঠিক না করলে চিংড়ি খাতের রপ্তানি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মনিরুল মামুন জানিয়েছেন, সুন্দরবনের নদী-খালগুলোতে প্রজনন ও বিচরণ কমায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। তবে বন বিভাগ ও মৎস্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে কিছুটা হলেও উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব।
চিংড়ি খাতের এই অবনতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি দেশের ‘সাদা সোনা’ হিসেবে খ্যাত এই খাতের ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা। এখন প্রয়োজন কার্যকর নীতি, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা, যাতে বাংলাদেশের চিংড়ি পুনরায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের শীর্ষস্থান ফিরে পেতে পারে।