ব্যবসায়ী মহল সময় বাড়ানোর দাবি তুললেও এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এখন সরকারের হাতে নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে জাতিসংঘের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশ, নেপাল ও লাওসের উত্তরণ বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলোচনা হবে। সব সদস্যরাষ্ট্রের মতামতের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে কে কখন এলডিসি তালিকা থেকে বের হবে। ফলে ব্যবসায়ীদের সময় বাড়ানোর যুক্তি বাস্তবসম্মত নয়।
আগামী ফেব্রুয়ারি মধ্যভাগে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সময় বাড়ানোর আবেদন করা সমীচীন হবে না বলে মনে করেন সরকারপক্ষের আলোচকেরা। তাঁদের মতে, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নতুন সরকারের হাতে ন্যস্ত হওয়া উচিত।
গত শনিবার রাজধানীতে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি’ শীর্ষক সেমিনারে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও প্রধান উপদেষ্টার অর্থবিষয়ক বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী প্রবন্ধে জানান, বাংলাদেশ জাতিসংঘের তিনটি সূচক—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক—ই ইতিমধ্যে পূরণ করেছে। ২০১৮ সালে প্রথমবার মানদণ্ড পূরণ করে বাংলাদেশ, পরে ২০২১ সালে আবারও তা অতিক্রম করে। কোভিডের কারণে সময় বাড়িয়ে ২০২৬ সাল নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সময় একবার পেছানো হয়েছে।
ইআরএফের প্রেসিডেন্ট দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, গত এক দশকে ভুয়া তথ্য, মূলধন পাচার ও দুর্বল প্রস্তুতির কারণে এলডিসি উত্তরণ নিয়ে কিছু সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অর্থনীতি আবারও গতি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৮ শতাংশ। এ বাস্তবতায় নেপাল ও লাওসের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। ফলে এখন আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই।
তিনি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়ীরা চাইলে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারেন। তবে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের করার মতো তেমন কিছু নেই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে নতুন সরকারকে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চপর্যায়ের লবিং গুরুত্বপূর্ণ। আমদানিকারক দেশগুলোকে রাজি করাতে বেসরকারি খাতকেই উদ্যোগ নিতে হবে, ব্যবসায়ীদের আরও সক্রিয় হতে হবে।
বিশেষ অতিথি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ঝুঁকি নিলে সুযোগ আসে। অতীতে ঝুঁকি নিয়ে তৈরি পোশাক খাত এগিয়েছে। তাই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন থেকে বড় ক্ষতি হবে না। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি ভিন্ন। সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, অর্থনীতি এখনও আইসিইউ থেকে পুরোপুরি বের হয়নি। রপ্তানি খাতের প্রস্তুতি অপ্রতুল থাকায় আরও সময় দরকার। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম অভিযোগ করেন, আগের সরকার ভুয়া তথ্য দেখিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সরকার এখনও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেনি। ফলে ব্যবসায়ীরা উত্তরণপ্রক্রিয়ার বিষয়ে সরকারের মনোভাব জানতে পারছেন না। বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান (বাবলু) বলেন, উত্তরণ ঘটলেও ইউরোপের অগ্রাধিকারমূলক বাজার হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।
ফার্মাসিউটিক্যাল খাত থেকেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান নির্বাহী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলো শুল্ক বাড়লে বাংলাদেশে উৎপাদন বন্ধ করতে পারে। এতে অনেক ওষুধের দাম বাড়বে।
পলিসি এক্সচেঞ্জর চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. এম মাশরুর রিয়াজ অনুষ্ঠানে সব আলোচনার মূল্যায়ন করে বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণ অবশ্যই ঘটবে, প্রশ্ন শুধু সময়ের। নেপাল ও লাওসের বাজার ছোট হওয়ায় তাদের ঝুঁকি কম। বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বড় হওয়ায় চ্যালেঞ্জ বেশি।’ তবু আলোচকদের সর্বসম্মত অভিমত, বাংলাদেশের অর্জন ও প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে এলডিসি উত্তরণ আর পেছানোর যুক্তি নেই। এখন প্রয়োজন বেসরকারি খাত ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগে নতুন বাস্তবতায় মানিয়ে নেওয়া।