দেশে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ও হাঁসসহ বিভিন্ন প্রাণিসম্পদের সংখ্যা ৪৫ কোটির বেশি। প্রাণিসম্পদের খাদ্যের জন্য দেশে গড়ে উঠেছে ফিডমিল বা প্রাণিখাদ্য উৎপাদন কারখানা। বর্তমানে এই খাত প্রায় সম্পূর্ণ দেশীয় ভুট্টার ওপর নির্ভরশীল। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ফিড বাজারের আকার প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। ফিডের চাহিদার কারণে দেশে ভুট্টার উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একাধিক ফিডমিল মালিক ও খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে উৎপাদিত ফিডের ৬০ শতাংশ পোলট্রি খাতে ব্যবহৃত হয়। ২৫ শতাংশ মৎস্য খাতে, আর বাকি ১৫ শতাংশ গবাদিপশুর জন্য। দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় ৪০০টি ফিডমিল আছে। এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিবন্ধিত ফিডমিল প্রায় ৩০০টি। বাকি ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান অনিবন্ধিত।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (ফিয়াব)। এতে পোলট্রি, মাছ ও গবাদিপশুর ফিড উৎপাদকেরা অন্তর্ভুক্ত। সমিতির সদস্যসংখ্যা ১১৬। খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান সমিতির বাইরে থাকায় জেলা ও উপজেলায় অনেক ফিডমিল সমিতির আওতায় নেই। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণিখাদ্য খাতের বাজার এখন প্রায় ৫০–৬০ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত কারখানায় বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন ফিড উৎপাদিত হয়। নিবন্ধনের বাইরে আরও প্রায় ৫ লাখ টন ফিড উৎপাদিত হয়। প্রতি টন মুরগির খাবারের দাম ৫৬–৬২ হাজার টাকা, পশু ও মাছের খাবারের প্রতি টন ৬০–৬৫ হাজার টাকা। গড়ে প্রতি টন খাবারের দাম ৬২ হাজার টাকা ধরে বাজারের আকার দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। খাত সংশ্লিষ্টরা উপখাতের বাজারসহ বাজারের আকার ৭০–৮০ হাজার কোটি টাকা মনে করেন।
স্পেক্ট্রা হেক্সা ফিডসের পরিচালক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, সরাসরি ফিডের বাজার ছাড়াও উপখাতের কয়েক হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। চিংড়ির জন্য ভারত থেকেও অল্প পরিমাণ খাবার আমদানি হয়। বছরে স্পেক্ট্রা হেক্সা ফিডসে দেড় লাখ টন প্রাণিখাদ্য উৎপাদিত হয়। খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৫০–৬০ হাজার কোটি টাকা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, গ্রামের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনো গৃহপালিত পশু পালন করে। তাদের খাদ্যের জন্য খরচের ৬০–৭০ শতাংশ ব্যয় হয়। দেশে বার্ষিক প্রাণিখাদ্যের চাহিদা প্রায় ৭৫–৮০ লাখ মেট্রিক টন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অলটেকের ‘ফিড জরিপ প্রতিবেদন-২০২৫’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বে মোট ফিড উৎপাদন ছিল প্রায় ১৪০ কোটি মেট্রিক টন। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত ও মেক্সিকো শীর্ষে। বাংলাদেশে প্রাণিখাদ্য বাজারের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে: নারিশ পোলট্রি, এসিআই গোদরেজ, আরআরপি অ্যাগ্রো, প্যারাগন, কাজী ফার্মস, সিপি বাংলাদেশ, কোয়ালিটি ও আকিজ ফিডস। এসব প্রতিষ্ঠানই বাজারের বড় অংশ দখল করে। অধিকাংশ বড় প্রতিষ্ঠান ২০০০ সালের পরে গড়ে উঠেছে।
আইডিএলসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজারের সর্বোচ্চ অংশ নারিশ পোলট্রির (১০.৫%), এরপর এসিআই গোদরেজ (৭.৮১%), আরআরপি অ্যাগ্রো (৭.৫১%), প্যারাগন ও কাজী ফার্মস চতুর্থ ও পঞ্চম, এরপর সিপি বাংলাদেশ ও কোয়ালিটি ফিডস। কোয়ালিটি ফিডস ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৫.৫ লাখ মেট্রিক টন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহতেশাম বি শাহজাহান জানান, প্রান্তিক খামারিদের বাকিতে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। তবে ডিম ও মুরগির দাম কম থাকায় খামারিরা লোকসান করছেন। এতে অনেক খামার বন্ধ হচ্ছে।
এসিআই অ্যাগ্রোভেটের অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রান্তিক হ্যাচারি ও খামারিরা লোকসানে থাকলে আমাদের ব্যবসাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ডিম-মুরগির ভালো দাম না থাকলে বাকিতে দেওয়া ফিডের মূল্যও পাওয়া যায় না। ফিড উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ভুট্টা। দেশীয় ভুট্টার মাধ্যমে ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়, বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি করা হয়। এছাড়া প্রোটিনসমৃদ্ধ সয়ামিল ও বিভিন্ন ভিটামিন উপকরণও আমদানি করতে হয়। দেশে মাছের খাবার প্রতি কেজি ৫৫–১৫০ টাকা, অ্যাকোরিয়ামের মাছের খাবার ৭৫০–২,০০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগির খাবার ৫০–৭০ টাকা। হাঁসের খাবার ৫৫–৬৫ টাকা, গরুর খাবার ৪০–৫৫ টাকা। নন–ব্র্যান্ডের খাদ্য কিছুটা কম দামে বিক্রি হয়।
বিএলআরআই-এর সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, ফিড উৎপাদনে ভুট্টা ছাড়া বিদেশি উপকরণও লাগে। ডলারের দাম বেড়েছে, কর সুবিধা কমেছে। তাই ফিডের দাম কমছে না। পোলট্রি ও ডেইরি খাতের দ্রুত বিকাশ ফিড শিল্পকে গতিশীল করেছে। তবে সম্প্রতি এ খাত কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে। আয়কর সুবিধা কমানো, কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর, ডিম-মুরগির কম দাম প্রান্তিক খামারিদের ক্ষতির কারণ হয়েছে। এতে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে, যা ফিড শিল্পের বাজারকে প্রভাবিত করছে।
ফিয়াবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ‘আগে শিল্পের আয়কর ১৫ শতাংশ ছিল, এখন তা ২৭.৫ শতাংশ। উপকরণ আমদানিতেও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর বসানো হয়েছে। ডলার ও ব্যাংক ঋণের সুদ বৃদ্ধি খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।’ খামারিরা ফিডের দাম ও মান নিয়ে সচেতন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিস্বাস্থ্য শাখার উপপরিচালক শেখ শাহিনুর ইসলাম বলেন, ভালো কোম্পানিগুলো মানসম্মত ফিড তৈরি করে। তবে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান তদারকির বাইরে থাকায় তাদের ফিডের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।