ব্রাজিলের সান্তোষ বন্দর থেকে ২৭৮ কোটি টাকার চিনির কাঁচামাল নিয়ে ‘এমভি স্পার ক্যাপেলা’ জাহাজ গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় কিন্তু শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নিয়ে বিরোধের কারণে গত পাঁচ দিনেও কাঁচামাল খালাস করা সম্ভব হয়নি। ফলে এই চিনি উৎপাদনের জন্য কারখানায় নেওয়া যাচ্ছে না।
সাধারণত ভোগ্যপণ্য আমদানিতে আমদানিকারক যে দর ঘোষণা করেন, তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের মূল্য তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে কাস্টমস যাচাই করে শুল্ক নির্ধারণ করে। কিন্তু এই চালানে আমদানি মূল্য কম থাকার কারণে কাস্টমস আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যে শুল্কায়ন করেনি। কাস্টমস জানিয়েছে, সমসাময়িক ঘোষিত মূল্য অনুযায়ী শুল্কায়নের প্রক্রিয়া চলছে। আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্য টনপ্রতি ৪০৪.৫১ ডলার হলেও কাস্টমস টনপ্রতি ৪২৬ ডলারে শুল্ক নির্ধারণের প্রক্রিয়া করছে।
এই পরিস্থিতিতে আমদানিকারক ব্যাংক গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দিয়ে সাময়িক শুল্কায়নের মাধ্যমে খালাসের আবেদন করেছে। কাস্টমস এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। চিনির কাঁচামাল বিদেশি জাহাজ ভাড়া করে আনা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে খালাস না হলে জাহাজের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। চিনিতে বর্তমানে শুল্ক–কর বেশি। শুল্ক নির্ধারণ করা হয় শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের ভিত্তিতে। যদি আমদানির চেয়ে শুল্কায়ন মূল্য বেশি হয়, তাহলে আমদানিকারককে বাড়তি শুল্ক দিতে হয়। পরিশেষে এই খরচ ভোক্তার ওপর পড়ে।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, এই চালান আমদানি করেছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অবস্থিত মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড। ব্রাজিলের চিনি সরবরাহ করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক উইলমার। মোট ৫৬ হাজার ৭৩ টন চিনি আনা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ ডলারে। জাহাজভাড়া সহ টনপ্রতি খরচ পড়েছে ৪০৪.৫১ ডলার, মোট খরচ ২৭৮ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল এক্সচেঞ্জ (আইসিই)’ চিনি বেচাকেনার জন্য বিশ্ববাজারে নির্ভরযোগ্য মূল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আমদানিকারক জানিয়েছে, এপ্রিল থেকে জুনে এসব চিনি কেনা হয়েছে। ওই সময় গড় দর টনপ্রতি ৩৭৬ ডলার। তাদের হিসাব অনুযায়ী ক্রয়মূল্য টনপ্রতি ৩৭৫.০১ ডলার, জাহাজভাড়া ছাড়া।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপমহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার জানিয়েছেন, “আগে কখনো আমদানি মূল্যের চেয়ে শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হয়নি। বিশ্ববাজারের দর যাচাই করে আমরা শুল্কায়নের আবেদন করেছি। যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয় এবং জাহাজ ক্ষতিপূরণ দিতে না হয়। ব্যাংক নিশ্চয়তা দিয়ে সাময়িক শুল্কায়নের মাধ্যমে খালাসের আবেদন করেছি।” কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার সৈয়দ মোকাদ্দেস হোসেন বলেন, “শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা অনুযায়ী প্রক্রিয়া চলছে। সমসাময়িক সময়ে একই রকমের আমদানিকারকের সর্বনিম্ন ঘোষিত মূল্যে শুল্কায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।”
চিনিতে ভোগ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শুল্ক–কর। অপরিশোধিত চিনি কারখানায় পরিশোধন করে বাজারজাত করা হয়। উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানকে টনপ্রতি ৩ হাজার টাকা কাস্টমস শুল্ক দিতে হয়। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর এবং ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর রয়েছে। গত মাসে কেজিপ্রতি ২৩ টাকা শুল্ক আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরে ১৪ লাখ ১৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি এবং ২.৫ লাখ টন পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৬ লাখ ৭০ হাজার টন। সরকার চিনি থেকে ৫ হাজার ২২৯ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে।
বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমছে। সর্বশেষ কমোডিটি এক্সচেঞ্জে প্রতি পাউন্ড চিনি ১৫.৭৯ সেন্টে বেচাকেনা হয়েছে। জাহাজভাড়া ছাড়া টনপ্রতি দাম ৩৪৮ ডলার। আগস্টে গড়ে দাম ছিল ৩৬১ ডলার, যা টনপ্রতি ১৩.৩৩ ডলার কম। কেজিপ্রতি কমেছে ১.৬৩ টাকা। দেশের বাজারেও চিনির দাম কমছে। প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ১১০ টাকা, খোলা চিনি ১০৫ টাকায়। এক বছর আগের তুলনায় দাম কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। আমদানিকারকরা বলছেন, নতুন দাম কম হলেও কাস্টমস শুল্কায়ন মূল্য যদি কমানো না হয়, তাহলে বাড়তি খরচ তাদের উপর থাকবে। শেষ পর্যন্ত এই খরচ পণ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভোক্তার ওপর পড়বে।