বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আপত্তি থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার জন্য চারটি কোম্পানিকে ইজারা দিয়েছে। ইজারা নেওয়ার পরই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ ছাড়াই বালু উত্তোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিআইডব্লিউটিএ আশঙ্কা করছে, এতে উপকূলে ভাঙন, পরিবেশ বিপর্যয় এবং চ্যানেলটির ক্ষতি হতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতু থেকে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া পর্যন্ত এলাকা পোর্ট লিমিট হিসেবে নির্ধারিত। ২০১৯ সালে মিরসরাই ইকোনমিক জোনের কাজ শুরু হলে কাগজপত্রে পোর্ট লিমিট মিরসরাই পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তবে এ অঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ কখনোই বন্দর কর্তৃপক্ষ করেনি। বহু বছর ধরে কাট্টলী থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণ করছে বিআইডব্লিউটিএ।
২০২০ সালে সীতাকুণ্ড উপকূলে মিরসরাই-রাশমনি নদীবন্দর এবং পরবর্তীতে সন্দ্বীপ এলাকায় উপকূলীয় বন্দর ঘোষণা করা হয়। সরকার এই দুটি বন্দরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গেজেট আকারে বিআইডব্লিউটিএকে দিয়েছে। এর ফলে রাসমণি ঘাট থেকে মিরসরাই ইকোনমিক জোন এবং সন্দ্বীপ উপকূলীয় বন্দরের সীমানা পর্যন্ত এলাকা আনুষ্ঠানিকভাবে বিআইডব্লিউটিএর আওতায় আসে।
যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কোনো আলোচনা ছাড়াই মিরসরাই পর্যন্ত পোর্ট লিমিট বাড়ানো হয়, রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ ও বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। এই সীমানার ভেতরে একটি নদীবন্দর, একটি উপকূলীয় বন্দর এবং সীতাকুণ্ড উপকূলের প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। সন্দ্বীপ–সীতাকুণ্ড নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য পাঁচটি ঘাট রয়েছে, যা জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে পরিচালনা করে। তবে ২০১৯ সালে পোর্ট লিমিট সম্প্রসারণের পরও কাজের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ হয়নি।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সলিমপুর থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত এলাকা চারটি ব্লকে ভাগ করে এক বছরের জন্য ড্রেজিংয়ের টেন্ডার আহ্বান করে। বিআইডব্লিউটিএ একাধিকবার টেন্ডার স্থগিতের চিঠি দিলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ আপত্তি উপেক্ষা করে প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়। ১ নম্বর ব্লকের দায়িত্ব পায় রাইজিং কম্পানি, ২ নম্বর ব্লকে ডিপ ডিঘার্স, ৩ নম্বরে কনস্টা এইচএলআই এবং ৪ নম্বরে এমআরআই।
এইভাবে চার প্রতিষ্ঠান বালু কাটার অনুমতি পেয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হলেও এখনো কোনো সমাধান হয়নি। সূত্র বলছে, চ্যানেলে নিয়মিত হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে খাল ও ঘাট এলাকায় ড্রেজিং ও সংরক্ষণ করে থাকে বিআইডব্লিউটিএ। প্রথমে জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএর কাছে অনুমতি চেয়েও ব্যর্থ হয় সিন্ডিকেট। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অনুমোদন নিয়ে বালু কাটার কাজ শুরু হয়।
বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিন্ডিকেট মূলত চট্টগ্রাম-সীতাকুণ্ড অংশ থেকে বালু তোলার পরিকল্পনা করছে। এই এলাকা অত্যন্ত সংবেদনশীল, কারণ এখানে জাহাজভাঙা শিল্প এবং চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপের কয়েক লাখ মানুষের যাতায়াতের একমাত্র পথ রয়েছে। উন্মুক্তভাবে বালু কাটার অনুমতি দিলে চার প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য নৌযান চলাচলে জাহাজভাঙা শিল্প এবং নৌপথ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘কাট্টলী থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত রুট বহু বছর ধরে আমাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সম্প্রতি সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপে দুটি বন্দর ঘোষণার পর পুরো এলাকার মালিকানা আরো সুস্পষ্ট হয়। বন্দরের পোর্ট লিমিট মিরসরাই পর্যন্ত বাড়ানো হলেও এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। হঠাৎ কোনো আলোচনা ছাড়াই টেন্ডার আহ্বান করা বিস্ময়কর। এজন্য আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি।’
চট্টগ্রাম বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক নয়ন শীল বলেন, ‘জরিপের মাধ্যমে ড্রেজিং ও বালি উত্তোলন না হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল ভাঙনসহ সংকটের মধ্যে পড়বে।’ অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘মিরসরাই পর্যন্ত পোর্ট লিমিট বৃদ্ধির ফলে পুরো এলাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্দরের আওতায় এসেছে। নাব্য ধরে রাখতে ড্রেজিং নিয়মিত প্রক্রিয়ার অংশ। টেন্ডার আহ্বান সেই ধারাবাহিকতায় হয়েছে।’