বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি প্রধান স্তম্ভ- ব্যাংক খাত, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং শেয়ারবাজার বর্তমানে গভীর সংকটের মুখোমুখি। ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণের সংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতি এক ধরণের স্থিতিশীলতার অভাব তৈরি করেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, আর আর্থিক সেবা কার্যকরভাবে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতও খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে আটকে গেছে, আবার খেলাপি ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে এবং এতে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই খাতের দুর্বলতা শুধু নিজস্ব প্রতিষ্ঠানকে নয়, পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
শেয়ারবাজারও ব্যাংক খাতের দুর্বলতার প্রভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যাংকের একীভূতকরণের (মার্জার) কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে, যা বাজার সূচকের দরপতনের প্রধান কারণ। বাজারে জাঙ্ক কোম্পানির তালিকাভুক্তি এবং অদক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতাকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। ফলস্বরূপ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারে বিনিয়োগ করতে অনিচ্ছুক হচ্ছে, আর প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বিনিয়োগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এই তিনটি খাত একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একটি নেতিবাচক চক্র তৈরি করেছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, শেয়ারবাজার এবং এনবিএফআই খাতের দুর্বলতার সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের এই সমস্যাগুলো সমাধান করা না গেলে দেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগের পরিবেশ এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস্তবসম্মত সমাধান, সুশাসনের নিশ্চয়তা এবং কার্যকর সংস্কারমূলক পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হিসেবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে ‘জাঙ্ক স্টক’-এ অযথা বিনিয়োগ, দুর্বল পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা চিহ্নিত করা হচ্ছে। এছাড়াও বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নীতি প্রণয়নের অসঙ্গতি, দক্ষ জনশক্তির অভাব এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে। এই সব কারণ একত্রে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে।
ব্যাংক খাত দীর্ঘদিনের শিথিল নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূলধন পর্যাপ্ততা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম এবং অনেক ব্যাংকের প্রভিশনিং বা ঝুঁকি মোকাবেলার ক্ষমতাও অপর্যাপ্ত। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ও তার বাস্তবায়নে শিথিলতা ব্যাংক খাতের দুর্বলতাকে আরও গভীর করেছে।
শেয়ারবাজারেও অবনতি মূলত ব্যাংকের ‘জাঙ্ক স্টক’-এ বড় বিনিয়োগ এবং দক্ষ পোর্টফোলিও ম্যানেজারের অভাবের কারণে ঘটেছে। বহু বছর ধরে খারাপ পারফরম্যান্স বা দুর্বল আর্থিক অবস্থায় থাকা কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ বড় লোকসান সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনীতির সামগ্রিক চাপও বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে বাজারের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়েছে।
অর্থনীতিতে এই ভাঙন দেখা দেয় যখন ব্যাংক খাত ও শেয়ারবাজার, অর্থনীতির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, দু’টিই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং একে অপরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যাংকের আর্থিক অস্থিতিশীলতা এবং শেয়ারবাজারের লোকসান জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়, যা বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও হ্রাস করে। একে বিশেষজ্ঞরা সিস্টেমিক রিস্ক হিসেবে বর্ণনা করছেন, যেখানে একটি খাতের সমস্যা অন্য খাতের মাধ্যমে পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং একক ঘটনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ, দক্ষ প্রশাসন, স্বচ্ছ নীতি প্রয়োগ এবং দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের বিকল্প নেই। ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেবল দেশের অর্থনীতিকেই পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।
খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্রে আস্থাহীন হয়ে পড়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্রে বন্দি হয়ে আস্থাহীনতার এক গভীর সঙ্কটে পড়েছে। দীর্ঘদিনের শিথিল নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব আর দুর্নীতির কারণে ঋণ সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে ঋণ আদায়ের সক্ষমতা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা।
তবে এটিই পুরো চিত্র নয়। ব্যালেন্স শিটের বাইরে লুকিয়ে থাকা আরও ৩ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ প্রকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা প্রায় ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি, অবলোপনকৃত ৮০ হাজার কোটি এবং আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে থাকা ৬০ হাজার কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত। সব মিলিয়ে সেন্ট্রাল ক্রেডিট ব্যুরো (সিআইবি) হালনাগাদ হলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত অঙ্ক ৯ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান।
এমন এক সংকটকালেই সরকার প্রণীত নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ সংজ্ঞা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। খসড়ায় যুক্তি দেওয়া হয়েছে, খেলাপি চিহ্নিত করার ধাপগুলো জটিল এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অথচ ২০২৩ সালের সংশোধিত আইনে প্রতিটি ব্যাংককে বাধ্যতামূলকভাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে বলা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত খেলাপির তথ্য প্রকাশ না করলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং এই সংস্কার ব্যাংক খাতের সুশাসনের পথে আরও বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গত সরকারের সময়ে ঋণের নামে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করেননি। তাই রাজনৈতিক চাপ এবং প্রভাবশালীদের স্বার্থেই নতুন খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ শব্দ বাদ দেওয়ার উদ্যোগ এসেছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদক্ষেপ নিলে ঋণখেলাপিদের দায়মুক্তি আরও সহজ হবে এবং ব্যাংকিং খাতের প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, পুনঃতফসিল, অবলোপন আর সুদ মওকুফের সংস্কৃতি কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণের অঙ্ক কমালেও বাস্তবে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য কোনোভাবেই উন্নত করে না। তিনি বলেন, “যা ঘটছে, তা-ই প্রকাশ করতে হবে। বাস্তব চিত্র গোপন করলে সাময়িক স্বস্তি মিললেও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাত আরও বিপর্যস্ত হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, এখন থেকে আর কোনো তথ্য গোপন রাখা হবে না। সব খেলাপি ঋণ প্রকাশ করা হবে এবং ঋণ আদায়ের কার্যক্রম কঠোরভাবে চালানো হবে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে দেখলেও তারা মনে করছেন শুধু ঘোষণা নয়, বরং আইনের কঠোর প্রয়োগ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন ছাড়া এই দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। তাই ব্যাংক খাতকে টেকসই ও আস্থাভিত্তিক করতে হলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা এবং অনিয়মের সংস্কৃতি ভাঙা জরুরি। নইলে ৯ লাখ কোটি টাকার ঋণখেলাপির বোঝা শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থা নয়, গোটা অর্থনীতিকেই অচল করে দিতে পারে।
খেলাপি ঋণের বোঝায় এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ: বাংলাদেশ এখন খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্রে জর্জরিত হয়ে এশিয়ার শীর্ষে উঠে এসেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশের মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২০ দশমিক ২ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি। এডিবির ভাষায়, বাংলাদেশ বর্তমানে এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার দেশ। উদ্বেগজনক বিষয় হলো এই সময়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘদিনের শিথিল নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণই এই অবস্থার মূল কারণ। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেছেন, ‘‘নিয়ম যত কঠোর করা হচ্ছে, খেলাপি ঋণের অঙ্ক ততই বাড়ছে। ভারতের মতো সাহসী ও কার্যকর সংস্কার ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।’’ একইভাবে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ‘‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না করলে এবং বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী না করলে কোনো সংস্কার কার্যকর হবে না।’’
অর্থনীতিবিদদের মতে, শুধু নীতি প্রণয়ন বা কাগুজে সংস্কার যথেষ্ট নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণের হিসাব প্রকাশ, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিতকরণ, ঋণ পুনরুদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন জরুরি। নইলে খেলাপি ঋণের বোঝা শুধু ব্যাংক খাত নয়, গোটা অর্থনীতিকেই অচল করে দিতে পারে।
খেলাপি ঋণে ডুবতে থাকা পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক যেমন: ফার্স্ট সিকিউরিটি, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও এক্সিম এবার একীভূত করে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নতুন ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন ব্যাংকের সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’, যা দেশের ইসলামী ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সরকার এই উদ্যোগের জন্য অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন যোগান দেবে। বর্তমানে এই পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪৮ থেকে ৯৮ শতাংশের মধ্যে পরিবর্তিত হচ্ছে, যা তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে তুলেছে। ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধু খেলাপি ঋণের বোঝা হ্রাস পাবে না, বরং আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষের আস্থাও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এই বিষয়ে বলেন, “আমরা এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি যাতে আমানতকারীরা নিরাপদে থাকেন। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার সব দায়‑দায়িত্ব নেবে এবং নতুন ব্যাংকটি শক্তিশালীভাবে পরিচালিত হবে।” বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধুমাত্র সংযুক্তি নয়; নতুন ব্যাংকের কার্যকর ব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার ও সুদমুক্ত পোর্টফোলিও গঠনের মাধ্যমে খাতটি টেকসইভাবে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। এই উদ্যোগ ইসলামী ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি খেলাপি ঋণ ও অস্থিতিশীলতার বীভৎস চক্র ভাঙতে সহায়তা করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অবদান রাখবে।
অপরদিকে ক্রমেই অবনতি দেখা দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সমূহে। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিস্থিতি দিন দিন সংকটজনক হয়ে উঠছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে তাদের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, তবে আদায় হয়েছে মাত্র ২১৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধাক্কা। বিশেষভাবে জনতা ব্যাংকের অবস্থাই সবচেয়ে উদ্বেগজনক; তাদের খেলাপি ঋণ বর্তমানে ৭০ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৭৫ শতাংশ।
তবে কিছু ইতিবাচক দিকও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জুলাই মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশে, যা আগের মাসের তুলনায় সামান্য হলেও উন্নতি। ব্যাংক কর্মকর্তারা এটিকে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যদি এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যায় এবং খেলাপি ঋণের পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানাচ্ছেন, শুধুমাত্র আমানতের বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়; খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ, কঠোর পুনঃতফসিল নীতি এবং স্বচ্ছ প্রশাসন ছাড়া এই খাতের দুর্বলতা দীর্ঘমেয়াদে আটকে থাকবে। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে আবর্তিত এনবিএফআই খাত: বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অস্থিরতা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এই খাতে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০টি সমস্যাগ্রস্ত এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণপোর্টফোলিওর ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের জন্য সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কার্যত এই খাত দেউলিয়া অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এনবিএফআইগুলোতে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় মানুষের আস্থা হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ২০ প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, কিন্তু জামানতের পরিমাণ মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশই সুরক্ষিত। এই বাস্তবতা স্পষ্ট করে যে, এই খাতের কার্যক্রমের টেকসইতা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের খবর অনুযায়ী, যদি দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে এনবিএফআই খাত পুরোপুরি ধসে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার, কঠোর তত্ত্বাবধান এবং স্বচ্ছ প্রশাসন ছাড়া এই খাতকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তাই অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আস্থাহীন বিনিয়োগকারীর ছায়ায় শেয়ারবাজার: অর্থনীতির তৃতীয় স্তম্ভ শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরে নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। দেশের শেয়ারবাজার গত ১৬ বছরে প্রায় ৩৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে, আর মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে বিনিয়োগকারীরা প্রতিবছর গড়ে ৩ শতাংশ হারে মূলধন হারিয়েছেন। অন্যদিকে বাজারের এই অস্থিরতাকে ব্যবহার করে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বিপুল সম্পদ উপার্জন করেছে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ করেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত ৩৯৭ কোম্পানির মধ্যে ৯৮টির বর্তমানে শেয়ার ফেস ভ্যালু ১০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে এবং এর অর্ধেকের বেশি শেয়ারের দাম ৫ টাকারও কম। এই তালিকায় রয়েছে ৩৩টি ব্যাংক ও এনবিএফআই, ৩৫টি মিউচুয়াল ফান্ড এবং ১৭টি টেক্সটাইল কোম্পানি। এই পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, বাজারের বড় অংশই কার্যত “জাঙ্ক শেয়ার” হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিইও কাজী মনিরুল ইসলাম বলেন, “এত বিপুল সংখ্যক শেয়ারের দর ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া প্রমাণ করে যে, কোম্পানিগুলোর পারফরম্যান্স ভালো নয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা অল্প কয়েকটি ভালো কোম্পানির দিকে ঝুঁকছেন, যা বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে।”
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “শেয়ারবাজারে এত জাঙ্ক শেয়ার বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বাঁধা। দুর্বল কোম্পানিগুলোকে দ্রুত বন্ধ বা একীভূত করতে হবে এবং বাজারে নতুন, শক্তিশালী ও টেকসই কোম্পানি আনা জরুরি।” বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য শুধু নীতি প্রণয়ন নয়, কার্যকর তত্ত্বাবধান, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং শক্তিশালী কোম্পানির লিস্টিং বাধ্যতামূলক। নইলে শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরানো এবং দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের সংকট উত্তরণের পথ: বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারে গঠনমূলক সংস্কারের প্রয়োজন। ব্যাংক খাতে সংকট মোকাবিলার জন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা, খেলাপি ঋণ আদায় নিশ্চিত করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। ব্যাংকগুলোকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত করতে হবে এবং কৃত্রিমভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা উচিত নয়। আমানতকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং আর্থিক বাজারে বিনিয়োগকারীর আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের জন্য ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড মার্কেটকে জোরদার করাও অত্যন্ত জরুরি। এতে অর্থনীতিতে স্থিতিশীল মূলধন প্রবাহ নিশ্চিত হবে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উৎসাহিত হবে। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার, মূলধন সরবরাহ ও কার্যকর তত্ত্বাবধান ব্যাংক খাতকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করতে সহায়ক হবে।
শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দুর্বল ও ‘জাঙ্ক’ শেয়ারগুলো বন্ধ বা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা প্রয়োজন। বাজারে অস্বাভাবিক দর ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচিত, বার্ষিক হিসাব-নিকাশের আগে শেয়ার বিক্রি না করে বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা। মোটের উপর ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে কার্যকর সংস্কার, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা এবং পেশাদারিত্বই দেশের অর্থনীতিকে সংকটমুক্ত ও স্থিতিশীল রাখতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো না নিলে খেলাপি ঋণ, দুর্বল প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীর আস্থাহীনতা একটি দীর্ঘমেয়াদী সংকটের জন্ম দিতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক সংকটময় পর্যায়ে রয়েছে যেখানে ব্যাংক খাত, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শেয়ারবাজার, অর্থনীতির তিনটি প্রধান স্তম্ভ, সবই গুরুতর দুর্বলতার মুখে। খেলাপি ঋণ, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং জাঙ্ক কোম্পানির আধিপত্যের কারণে এই খাতগুলো একে অপরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা, খেলাপি ঋণ আদায় করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি পদক্ষেপ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের জন্য ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড মার্কেট জোরদার করা এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ বা একীভূত করা প্রয়োজন। যদি এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হয়, তবে বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে, আর্থিক বাজার স্থিতিশীল হবে এবং দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে সুষম ও টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগোতে পারবে। অন্যথায় তিনটি স্তম্ভের ভাঙন কেবল অর্থনীতিকে নয়, সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের জন্যও দীর্ঘমেয়াদী সংকট সৃষ্টি করতে পারে।