দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বড় পরিবর্তন আনল নতুন নীতিমালা। এত দিন অনেক কোম্পানিতে বিদেশি মালিকানা ছিল শতভাগ। এখন থেকে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ শতাংশ। ফলে বাংলালিংককে ১৫ শতাংশ এবং রবিকে ৫ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হবে দেশীয় অংশীদার বা শেয়ারবাজারে।
ফাইবার অপটিক্স, টাওয়ারসহ অবকাঠামো খাতে বিদেশি বিনিয়োগের পথও উন্মুক্ত হয়েছে। তবে সেখানে বিদেশি শেয়ারের সীমা আলাদা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। টাওয়ার ও ফাইবার খাতে বিদেশি অংশীদারিত্ব থাকবে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ, আর আন্তর্জাতিক সংযোগ সেবায় সীমা ৪৯ শতাংশ।
গত ৪ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দেয় ‘টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং’ নীতিমালাকে। গত সোমবার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তা কার্যকর হয়। সরকার বলছে, পুরোনো নীতিমালা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। অব্যবহৃত ফাইবার নেটওয়ার্ক, সাবমেরিন কেবল ব্যবহার না হওয়া, দুর্বল অবকাঠামো, লাইসেন্স জটিলতা ও নিম্নমানের সেবার কারণে খাতের অগ্রগতি থমকে গিয়েছিল। নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে গ্রাহকরা সাশ্রয়ী ও উন্নতমানের ভয়েস ও ডেটা সেবা পাবেন। উদ্যোক্তাদের জন্যও তৈরি হবে সহজ শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ। বিটিআরসি আগে ২৬ ধরনের লাইসেন্স দিত। এখন থেকে থাকবে চারটি মূল ক্যাটেগরি—
- অ্যাক্সেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার
- ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার
- ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার
- নন-টেরেস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার
এ ছাড়া টেলিকম-এনাবলড সার্ভিস প্রোভাইডার নামে আলাদা একটি তালিকা থাকবে। এতে এসএমএস অ্যাগ্রিগেশনসহ ছোট সেবা প্রদানকারীরা কাজ করতে পারবে। নীতিমালা বাস্তবায়নে তিন ধাপের রোডম্যাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে সব অপারেটরকে নতুন কাঠামোয় আসতে হবে। এর ফলে শতাধিক দেশি কোম্পানি যেমন আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স, এনআইএক্স বন্ধ হয়ে যাবে। খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে, এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়েছে এবং বিদেশি অপারেটরের একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হতে পারে।
দেশীয় উদ্যোক্তারা শুরু থেকেই এই নীতিমালার বিরোধিতা করছেন। তাদের দাবি, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিতেই নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে স্থানীয় বিনিয়োগ ও সরকারের রাজস্ব আহরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। জাতীয় স্বার্থ ও ডিজিটাল সার্বভৌমত্বও ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন, নতুন নীতিমালায় একক নিয়ন্ত্রণ ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো যাবে। প্রতিযোগিতামূলক সেবা নিশ্চিত হবে। রাজস্বও কমবে না। তিন বছরের মধ্যে দেশের ৮০ শতাংশ টাওয়ারকে ফাইবার নেটওয়ার্কে যুক্ত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উপকূলীয় অঞ্চল ও দুর্গম এলাকায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে জোর দেওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট মান সূচক নিশ্চিত করতে জাতীয় মান পর্যবেক্ষণ ড্যাশবোর্ড চালু করবে বিটিআরসি।
অপারেটরদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে। টাওয়ার ও ডেটা সেন্টারে সৌরশক্তি বা হাইব্রিড ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও কার্বন নিঃসরণ কমানো বাধ্যতামূলক করা হবে। একই সঙ্গে সাইবার হামলা ঠেকাতে নিতে হবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামোয় গঠন করতে হবে জরুরি প্রতিক্রিয়া দল।
বর্তমানে গ্রামীণফোনে টেলিনরের মালিকানা ৫৫.৮ শতাংশ, বাকি শেয়ার দেশীয় উদ্যোক্তা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। রবির ৯০ শতাংশ শেয়ার মালয়েশিয়ার আজিয়াটার হাতে, বাকি ১০ শতাংশ পুঁজিবাজারে। বাংলালিংকের শতভাগ মালিকানা দুবাইভিত্তিক ভিওনের কাছে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী রবিকে আরও ৫ শতাংশ আর বাংলালিংককে ১৫ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হবে।