বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার ওপর ডলারের চাপ কমলেও জুলাই থেকে বাজার থেকে ডলার কিনছে। এতে টাকার মান কৃত্রিমভাবে নিচে রাখা হয়েছে, যদিও মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশের ওপরে স্থায়ীভাবে আটকে আছে।
১৩ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ১.৮৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছে। এর ফলে বাজারে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা প্রবাহিত হয়েছে। ডলার ১২১ টাকার ওপরে ধরে রাখার পাশাপাশি রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট। এতে রপ্তানিকারক ও প্রবাসী আয় প্রেরকদের সহায়তা মিলছে।
মূল লক্ষ্য হলো রিজার্ভ বাড়ানো ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “ডলার কেনা মানে বাড়তি টাকা বাজারে ছাড়া। তবে ঋণপ্রবাহ না বাড়ায় এই টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভেতরেই ঘুরছে। অনেক ব্যাংক এই অর্থ ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ কম থাকায় ডলারের চাহিদা কমে গেছে। এতে বাজারে ডলার বেড়ে গেলেও বিনিয়োগের চাপ তৈরি হচ্ছে না। তিনি বলেন, ডলার কমে গেলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসী আয় কমতে পারে, তাই কৃত্রিমভাবে ডলার শক্ত রাখা হচ্ছে।
মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সেপ্টেম্বরে সুদহার কমিয়েছে ২৫ বেসিস পয়েন্ট। এতে বৈশ্বিকভাবে ডলার দুর্বল হবে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও ডলার কিনতে পারবে, অথচ মুদ্রাস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে না। বিবির এক কর্মকর্তা জানান, ডলারের মূল্য আইএমএফের নির্ধারিত ব্যান্ডের মধ্যে রাখা হচ্ছে। নিচে নামলে ডলার কেনা হয়, আর উপরে গেলে বিক্রি করা হয়।
ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি ২৫.৫ শতাংশ কমেছে। ফলে ডলারের চাহিদাও কমেছে। এ অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে রিজার্ভ বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নিলামে ডলার কেনা হয়েছে ১২১.৭৫ টাকায়, যা জুলাইয়ে ১২৩ টাকা ছিল।
আগস্টে মুদ্রাস্ফীতি নেমে এসেছে ৮.২৯ শতাংশে, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন কিন্তু এখনও বিবির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ শতাংশের অনেক ওপরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও সার সস্তা হলেও দেশে দাম সমন্বয় হয়নি। ব্যবসায়ীরাও এলসি খোলার সময় যে বেশি দামে ডলার কিনেছিলেন, এখন কম দামে ডলার কিনে খরচ না কমিয়ে বাড়তি মুনাফা করছেন। রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট সূচক অনুযায়ী টাকার মান এখনও অতিমূল্যায়িত। আগস্টে সূচক দাঁড়িয়েছে ১০৩, যেখানে ডলার হওয়া উচিত ১২৬ টাকার ওপরে। তবে বিবি কর্মকর্তার মতে, ডলারের বৈশ্বিক দুর্বলতাই মূল কারণ।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “ডলার বাজার হঠাৎ ওঠানামা করলে অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি হয়। ধীরে ধীরে বাড়া-কমা সমস্যা নয়, কিন্তু আকস্মিক পরিবর্তন ক্ষতিকর।” তিনি বলেন, “বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নিশ্চিত করতে নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা-বেচা হচ্ছে। এতে রিজার্ভও বাড়ছে। প্রয়োজনে আবার বাজারে ডলার ছাড়বে বাংলাদেশ ব্যাংক।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “২০২২-২৩ সালে প্রায় ৫০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি এসেছে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে। তাই টাকার মান বেশি শক্ত হলে আমদানি খরচ কমবে, তবে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।” বাংলাদেশ ব্যাংক এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে—একদিকে রিজার্ভ বাড়ানো ও রপ্তানি-রেমিট্যান্স রক্ষা, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। তবে বাস্তবে ব্যাংক প্রথম দিকেই জোর দিচ্ছে বেশি।