বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতি, দারিদ্র্য বিমোচন ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রাণিসম্পদ খাত এক অনন্য ভূমিকা পালন করছে। আজ এটি দেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়নমুখী খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রায় ১৫ লাখ প্রান্তিক খামারি দুই-তিনটি করে পশু পালন করে দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহ করেন। বিশেষ করে ঈদুল আজহা বা কোরবানির সময় প্রায় আট লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারি গবাদিপশু লালন-পালন করেন। দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। শুধু পোলট্রি খাতেই প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত, যার মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতের জিডিপিতে অবদান ১.৮১ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.১৯ শতাংশ। কৃষিজ জিডিপিতে এর অবদান ১৬.৫৪ শতাংশ। দেশে বর্তমানে প্রায় আড়াই কোটি গরু, ১৫ লাখ মহিষ, তিন কোটি ছাগল-ভেড়া ও ৪০ কোটি হাঁস-মুরগি রয়েছে। ২০২৪-২৫ সালে এসব গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি থেকে ১৫৫ লাখ টন দুধ, ৮৯.৫৪ লাখ টন মাংস এবং ২ হাজার ৪৪০ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রান্তিক খামারিদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, বাচ্চা সরবরাহ, খাদ্য, ভ্যাকসিন ও ওষুধ প্রদানের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। গার্মেন্টস শিল্পের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত হিসেবে পোলট্রি শিল্প ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে। এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অধিদপ্তরের আওতাধীন ৫০টি হাঁস-মুরগির খামার থেকে বছরে ৩৫ লাখ একদিনের বাচ্চা সরবরাহ করা হয়।
পোলট্রি ও ডেইরি খাতের সঙ্গে বাণিজ্যিক পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বিকাশ লাভ করেছে। দেশে বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন পোলট্রি ও ডেইরি ফিড উৎপাদন হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত ফিড মিলের সংখ্যা ৩৪২। মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন-২০১০ এবং পশুখাদ্য বিধিমালা-২০১৩ অনুযায়ী খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ডেইরি খাতও গুরুত্বপূর্ণ। দেশে প্রায় ২.৫ কোটি গবাদিপশুর মধ্যে ৮৬ লাখ দুগ্ধবতী গাভী রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ লাখ দেশীয় ও ৪১ লাখ সংকর জাতের গাভী। দুগ্ধ খাতের শতকরা ৮০ ভাগ খামারি প্রান্তিক, ভূমিহীন কৃষক ও নারী। তারা মোট উৎপাদিত দুধের ৭০ শতাংশ সরবরাহ করেন। গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতি বছর ১৭ লাখ উন্নত জাতের বাছুর উৎপাদন হয়। এ ছাড়া স্থানীয় জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়নে পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন রেড চিটাগাং ক্যাটেল, মীর কাদিম, পাবনা, নর্থ বেঙ্গল গ্রে ও নেত্রকোনা ব্ল্যাক।
অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কার্যক্রম চালাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল, সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরে মহিষের প্রাপ্যতা বেশি। সরকারি তিনটি মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামার (বাগেরহাট, টাঙ্গাইল ও সাভার) থেকে ভর্তুকি মূল্যে খামারিদের মাঝে মহিষের বাচ্চা সরবরাহ করা হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন চর ও খাস জমি সমবায়ভিত্তিক চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।
প্রাণিস্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিভিন্ন রোগবালাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতি বছর ১৭ রোগের প্রায় ৩৪ কোটি ডোজ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির টিকা উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়। সম্প্রতি গবাদিপশুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) নিয়ন্ত্রণে ১৭ লাখ টিকা মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষুরা রোগ (এফএমডি) মুক্ত অঞ্চল গঠনের জন্য সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ ও ভোলায় টিকাদান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ছাগলের সংক্রামক রোগ পিপিআর নির্মূলে প্রায় ছয় কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। মানবদেহে ছড়ায় এমন জুনোটিক রোগ (অ্যানথ্রাক্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জলাতংক, নিপা ভাইরাস) পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। দেশের জল, স্থল ও বিমানবন্দরগুলোতে ২৪টি কোয়ারেন্টাইন স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা ১৯৬৪ সালে মিরপুর ঢাকায় ১৮৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ১৩৫ প্রজাতির ৩,৩২৫টি প্রাণী আছে। বছরে প্রায় ৪০-৪৫ লাখ দর্শনার্থী চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করেন। রাজস্ব আসে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর কাছে স্বল্পমূল্যে প্রাণিজ আমিষ পৌঁছে দিতে ২০২৫ সালের রমজানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ও খামারিদের সহযোগিতায় ৪৯৫টি ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে দুধ, মাংস ও ডিম সরবরাহ করা হয়েছে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে ৯ লাখ ৬৮ হাজার ভোক্তার মাঝে ৩১ কোটি ৭৩ লাখ ১২ হাজার টাকার সমমূল্যের প্রাণিজ পণ্য বিক্রি হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ খাতে উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করা, তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা এবং সাধারণ মানুষকে খাতের গুরুত্ব জানাতে ‘জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ’ পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সময় খাতের প্রযুক্তি, উন্নত জাতের গবাদিপশু ও পোলট্রির প্রদর্শনী এবং বৈচিত্র্যময় প্রাণিজ খাবারের সঙ্গে পরিচয় করানো হয়।
সূত্র: আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: সচিব, মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

