বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল গভর্নরের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক আচরণ ও কর্মপরিবেশ সংকট নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ জানিয়েছে।
কাউন্সিলের পক্ষ থেকে গভর্নরের কাছে পাঠানো একটি বিস্তৃত লিখিত অভিযোগপত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরের অসন্তোষের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও কর্মকর্তাদের মধ্যে নিয়মিত ও স্বচ্ছ যোগাযোগের একটি ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপে সেই সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হলো—বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ভবনের ৪র্থ তলায় অবস্থিত এক্সিকিউটিভ ফ্লোরে হঠাৎ সব প্রবেশদ্বার তালাবদ্ধ করা। এখন কর্মকর্তারা কেবল লিফট ব্যবহার করে সেখানে যেতে পারছেন। তাঁদের দাবি, এটি নজিরবিহীন ও অপমানজনক।
কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ানোর ইঙ্গিত। অনেকে আশঙ্কা করছেন, গভর্নর ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে আলাদা রাখছেন যেন ভবিষ্যতে বিরূপ পদোন্নতি নীতিমালা বা কর্মকর্তাদের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়।
মহিলাকর্মীরা জানিয়েছেন, বাইরের লোকদের ব্যবহৃত পথ দিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ায় তাঁদের জন্য এটি নিরাপত্তাহীন ও অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছে।
কাউন্সিল বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের ধারাবাহিকতায় তারা অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের প্রত্যাশা করেছিল। ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের সামনে কাউন্সিল একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করে। গভর্নর তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কাউন্সিলকে সংস্কার কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু আট মাস পেরিয়ে গেলেও তাতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রথম শ্রেণির ৬২৬০ পদের মধ্যে ১৯৩৬টি শূন্য। নির্বাহী পরিচালকের চারটি পদ বহু বছর ধরে খালি। অতিরিক্ত পরিচালক পর্যায়েও ১৯ মের পর কোনো পদোন্নতি হয়নি, এমনকি ৩১ আগস্টের প্যানেলও এখনও অনুমোদন পায়নি।
কাউন্সিলের অভিযোগ—যোগ্য কর্মকর্তারা উপেক্ষিত হচ্ছেন, পদোন্নতি ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখা হচ্ছে।
দুদকের অনুরোধে বিভিন্ন স্থানে পরিদর্শনে যাওয়া কর্মকর্তাদেরকেও এখন অনিয়মের জন্য দায়ী করা হচ্ছে, যদিও এসব বিষয়ে গভর্নরকে জানানো হলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।
সরকারি অন্যান্য সংস্থার ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তাদের গাড়ি সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তা পাচ্ছেন না। লকার ফ্রিজ করে দেওয়ায় অনেক কর্মকর্তা পারিবারিক প্রয়োজনে নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্রও ব্যবহার করতে পারছেন না।
অন্যদিকে, সিনিয়র কর্মকর্তারা জুনিয়রদের চেয়ে কম বেতন পাওয়ার অস্বাভাবিকতাও দীর্ঘদিন ধরে রয়ে গেছে।
কাউন্সিলের আরও অভিযোগ—গভর্নর অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে ব্যয়বহুল উপদেষ্টা ও পরামর্শকদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করছেন। এদের অনেকেই দেশের ব্যাংকিং বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ, ফলে তাঁদের পরামর্শ প্রশাসনিক কাজে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সাক্ষাতের অনুরোধ করলেও গভর্নর ছয় মাসে একবার বৈঠক করার সিদ্ধান্ত জানান। অথচ তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন, ফলে গুরুত্বপূর্ণ নথি নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে।
প্রেষণ ভাতা বাতিল, প্রশিক্ষণের মেয়াদ ও ভাতা কমানোর মতো সিদ্ধান্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। তাঁদের মতে, এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংককে দুর্বল করার প্রচেষ্টা।
অতীতে স্বচ্ছ পদোন্নতি নীতিমালার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ছিল স্থিতিশীল। কিন্তু এখন কর্মকর্তাদের “অদক্ষ” আখ্যা দিয়ে নীতিমালা পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এতে রাজনৈতিক প্রভাবের সুযোগ বাড়বে।
অসন্তোষ নিরসনে কাউন্সিল দুটি দাবি জানিয়েছে—
১. দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
২. প্রতি ১৫ দিনে গভর্নরের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
কাউন্সিল বলছে, তারা সবসময় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও সহযোগিতা করতে চায়। তবে এজন্য দরকার উন্মুক্ত যোগাযোগ ও আস্থার পরিবেশ।
কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এ সংকট দ্রুত সমাধান না হলে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসনিক অচলাবস্থায় পড়তে পারে।

