চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে ডেনমার্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। প্রতিষ্ঠানটি এপি মোলার মার্সক গ্রুপের সহযোগী সংস্থা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে এই প্রকল্পে কোম্পানিটি ৫৫ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৬,৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
আগামী সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশকে ২৫০ কোটি টাকা ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে প্রদান করবে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকায় আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন এপিএম টার্মিনালসের গ্লোবাল চেয়ারম্যান এবং ডেনমার্ক সরকারের একজন মন্ত্রী।
গতকাল বুধবার অর্থনৈতিক বিষয়–সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটিতে এই চুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়। বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিস্তারিত জানান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষের সিইও চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন (আশিক চৌধুরী)।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য কমোডর আহমেদ আমিন আবদুল্লাহ।
২০২৯ সালে চালু হবে টার্মিনাল:
আশিক চৌধুরী জানান, আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হতে পারে। তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করে ২০২৯ সালে টার্মিনাল চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর ৩০ বছর এটি পরিচালনা করবে এপিএম টার্মিনালস। প্রয়োজনে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মেয়াদ আরও ১৫ বছর বাড়ানো যেতে পারে।
তিনি আরও জানান, এই প্রকল্পটি হবে বাংলাদেশে ইউরোপ থেকে আসা সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ। এতে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। পুরো ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারই এপিএম টার্মিনালস বিনিয়োগ করবে, যা তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে।
একই সভায় ঢাকার পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল চালুর বিষয়েও আলোচনা হয়। আশিক চৌধুরী বলেন, “আগামী সপ্তাহে এ–সংক্রান্ত চুক্তিও স্বাক্ষরিত হবে।”
৮-১০ লাখ কনটেইনার ধারণক্ষমতা:
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টিইইউ পর্যন্ত কনটেইনার পরিচালনা করতে পারবে। বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতার তুলনায় এটি প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। এর ফলে বন্দরের সামগ্রিক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
টার্মিনালটি থাকবে পতেঙ্গার চট্টগ্রাম বোট ক্লাব সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর তীরে। সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় এখানে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের তুলনায় দ্বিগুণ আকারের জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে সিঙ্গাপুর বা শ্রীলঙ্কায় ট্রান্সশিপমেন্টের প্রয়োজন পড়বে না। এতে রপ্তানি দ্রুত হবে, টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমবে এবং ইউরোপে সরাসরি পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে।
টার্মিনালটি ২৪ ঘণ্টা পরিচালিত হবে। এতে ৫০০ থেকে ৭০০ জনের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানানো হয়।
এপিএম টার্মিনালসের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা:
ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬০টি টার্মিনাল পরিচালনা করছে। বৈশ্বিক শীর্ষ ২০টি টার্মিনালের মধ্যে ১০টি পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
পিপিপি কর্তৃপক্ষের সিইও আশিক চৌধুরী বলেন, “ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনাল নির্মাণ করলেও এর মালিকানা থাকবে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে। তারা সরকারের জমিতে নতুন (গ্রিনফিল্ড) প্রকল্প হিসেবে এটি নির্মাণ করবে এবং ৩০ বছর পরিচালনা শেষে সম্পূর্ণ সম্পত্তি সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।
এপিএম টার্মিনালস টার্মিনাল পরিচালনা করলেও চার্জ নির্ধারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আশিক চৌধুরী বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি সীমা নির্ধারণ করবে যাতে অতিরিক্ত মাশুল আরোপ না করা যায়। মানসম্মত সেবা দিলে প্রতিষ্ঠান কিছুটা বেশি মূল্য নিতে পারবে, তবে তা নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যেই থাকবে। ভবিষ্যতে সব টার্মিনাল চালু হলে ধীরে ধীরে এই সীমা তুলে দেওয়া হতে পারে।”

