বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আবার এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তাদের বাজারে বিক্রি হওয়া সব পোশাকের জন্য চালু করতে যাচ্ছে ‘ডিজিটাল প্রোডাক্ট পাসপোর্ট (ডিপিপি)’ নামের একটি নতুন নিয়ম, যা পোশাকের উৎপাদন, সরবরাহ ও পরিবেশগত প্রভাবের পূর্ণ তথ্য রাখবে একটি ডিজিটাল কোডের মাধ্যমে।
২০২৭ সাল থেকে এটি বাধ্যতামূলক হবে, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্যকর করার পরিকল্পনা রয়েছে। মানে, সময় হাতে খুব বেশি নেই। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে তার সরবরাহ শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও তথ্যভিত্তিক করতে হবে। না হলে হারাতে হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার—ইউরোপ, যেখানে যায় আমাদের পোশাক রপ্তানির অর্ধেকেরও বেশি।
ডিপিপি মূলত প্রতিটি পোশাকে একটি ডিজিটাল আইডি বা কিউআর কোড যুক্ত করার প্রক্রিয়া। এই কোড স্ক্যান করলে দেখা যাবে সেই পোশাকের কাঁচামাল কোথা থেকে এসেছে, কোন কারখানায় তৈরি হয়েছে, উৎপাদনে কতটা পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে, এমনকি ব্যবহারের পর কীভাবে তা পুনর্ব্যবহার বা নিষ্পত্তি হবে—সব তথ্য।
এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো টেকসই উৎপাদন ও মানবাধিকার নিশ্চয়তা, যাতে ভোক্তারা জানতে পারেন তাদের কেনা পোশাক কতটা পরিবেশবান্ধব ও নৈতিক উপায়ে তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ইতোমধ্যে এই উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সংগঠনটির সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানিয়েছেন, ডিপিপি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রাথমিক পাইলট প্রকল্প চলছে।
বিজিএমইএ পরিচালক শেখ এইচ এম মুস্তাফিজ জানান, “প্রথম ধাপে ট্রেস করা হবে কোন প্রতিষ্ঠানগুলো সাপ্লাই চেইনে যুক্ত রয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে যোগ হবে পরিবেশগত বিষয়গুলো—যেমন পানি ব্যবহার, জ্বালানি খরচ, কার্বন নিঃসরণ ও শ্রমিকদের অধিকার।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “সরবরাহ চেইনের প্রতিটি ধাপে ইউরোপীয় মানদণ্ড মেনে চলা না গেলে, অনেক কারখানাই ইউরোপীয় বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।”
ডিপিপি আসছে ইইউ’র ‘ইকোডিজাইন ফর সাসটেইনেবল প্রোডাক্টস রেগুলেশন (ইএসপিআর)’ কাঠামোর আওতায়, যা প্রতিটি পণ্যের জীবনচক্রে টেকসইতা নিশ্চিত করবে। শুরুতে এটি পোশাক শিল্পে বাধ্যতামূলক হলেও, ভবিষ্যতে চামড়া, ইলেকট্রনিকস ও কৃষিপণ্যেও এটি প্রযোজ্য হবে।
বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৩৯.৩৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে, যার অর্ধেকের বেশি গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। ফলে এই বাজার হারানো মানে পুরো খাতের জন্য ভয়াবহ ধাক্কা।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। বিজিএমইএ’র পাইলট প্রকল্পটি চলছে উর্মি গ্রুপের একটি কারখানায়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, “এটি অনেক বড় প্রক্রিয়া। আমাদের সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি, তবে এখনো ইইউ পুরো স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করেনি। যখন সেটি চূড়ান্ত হবে, তখনই স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (SOP) তৈরি করা যাবে।”
তিনি যোগ করেন, “এই ট্রেসিং চেইন শুরু হবে কাঁচামালের উৎস থেকে। যার এক্সেস থাকবে, সে বারকোড স্ক্যান করে পুরো উৎপাদন ইতিহাস জানতে পারবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হবে।”
শেখ এইচ এম মুস্তাফিজ বলেন, “যেসব কারখানা এখনো ইইউ মানদণ্ডে প্রস্তুত নয়, তারা বড় ঝুঁকিতে আছে। কারণ তাদের সাপ্লায়াররাও সাধারণত নন-কমপ্লায়েন্ট। ফলে তারা প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে পারবে না।”
তিনি আরও জানান, এখনো কোনো একীভূত ডেটা প্ল্যাটফর্ম না থাকায় কারখানাগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে তথ্য দিতে হচ্ছে, যা সময় ও খরচ দুইই বাড়াচ্ছে। অনেক কারখানাকে এজন্য অতিরিক্ত জনবলও নিতে হবে।
বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোর ডিজিটাল অবকাঠামো এখনো দুর্বল। ডেটা ম্যানেজমেন্ট, লাইফসাইকেল অ্যানালাইসিস বা ইএসজি রিপোর্টিংয়ের মতো দক্ষতা এখানে খুবই সীমিত। ফলে তারা বড় ধরনের সহায়তা ছাড়া এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না।”
ডিজিটাল প্রোডাক্ট পাসপোর্ট শুধু একটি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়—এটি টেকসই বাণিজ্যের নতুন বিশ্বমানদণ্ড। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প যদি সময়মতো প্রস্তুত হতে পারে, তাহলে এটি আমাদের জন্য হুমকি নয়, বরং এক নতুন সুযোগও বয়ে আনতে পারে। কিন্তু সেই প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই, কারণ সময় আর বেশি নেই।

