দেশ থেকে ডলারের অস্বাভাবিক বহির্মুখী প্রবাহ আবারও উদ্বেগ তৈরি করেছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়লেও নতুন অর্থবছরের শুরুতেই আমদানি ব্যয় দ্রুত বেড়েছে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন চাপ দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের এই অস্বাভাবিক প্রবাহের পেছনে অর্থপাচারের নতুন ধাক্কা আছে কিনা তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি। তাদের মতে, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের উন্নতি বড় প্রাপ্তি হলেও তা ধরে রাখার জন্য ডলার প্রবাহের দিকনির্দেশনা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য, অর্থবছরের শুরুতেই বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। চলতি হিসাবেও ঘাটতি ফিরে এসেছে। এর সঙ্গে ডলারের দ্রুত বহির্গমন মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর সতর্ক সংকেত দেখা যাচ্ছে। তারা মনে করেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি বাড়লেও যদি অর্থপাচারের মাধ্যমে ডলার বাইরে চলে যায়, তাহলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হবে।
অর্থপাচারের শঙ্কা কেন বাড়ছে:
অর্থপাচারের শঙ্কা বাড়ছে—এর পেছনে কয়েকটি কারণ সরাসরি কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক হারে ডলার বহির্গমন হয়েছে। এর সঙ্গে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া আমদানি ব্যয় পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করেছে। ইনভয়েসিং ব্যবস্থায় অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশে চিকিৎসা ও ভ্রমণের ব্যয়ও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে বোঝা যায়, দেশ থেকে টাকা বের করে নেওয়ার পুরোনো পথগুলো আবার সক্রিয় হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখনকার পরিস্থিতিতে অর্থপাচারের ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
এক বছরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৫ শতাংশ:
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৭১ কোটি ডলারে। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৪৬৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ বা ১০৭ কোটি ডলার।
এই তিন মাসে রফতানি আয় হয়েছে ১ হাজার ১০৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বিপরীতে আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার। রমজানকে সামনে রেখে খাদ্য, ভোজ্যতেল, চিনি ও নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত আমদানি ডলারের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। একই সময়ে বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়ও বেড়েছে। এতে বৈদেশিক লেনদেনে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময় পর চলতি হিসাব আবার ঋণাত্মক হয়েছে। এ সময়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটি ডলারে।
ডলার কোথায় যাচ্ছে:
বিশ্লেষকদের মতে, প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় বাড়লেও হঠাৎ ডলারের দ্রুত বহির্গমন স্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিলছে না। তাদের ধারণা, এ প্রবাহের আড়ালে অর্থপাচারের ভূমিকা থাকতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “রেমিট্যান্স ও রফতানি প্রবাহ ইতিবাচক। তবু দেশ থেকে এত ডলার কোথায় যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। অস্বাভাবিক বহির্মুখী প্রবাহের মধ্যে অর্থপাচারের গন্ধ আছে।” তিনি মনে করেন, আমদানির কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হওয়ায় কিছু গোষ্ঠী সুযোগ নিচ্ছে। অতিরিক্ত ইনভয়েসিং বা ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে অর্থপাচার বন্ধ হয়নি। যারা সুযোগ পাচ্ছেন, তারা এখনও পাচার করছেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, “অর্থপাচার আগেও হতো, এখনও হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধ হয়ে গেছে—এমন ধারণার ভিত্তি নেই।” তিনি আরও বলেন, “পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ দেখা গেলেও পাচার বন্ধে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেই।” তার মতে, এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো অর্থপাচার প্রতিরোধকে মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা এবং সেই অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
রেমিট্যান্স বাড়ছে, বিনিয়োগে বিপরীত চিত্র:
চলতি সময় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৫৯ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি প্রায় ১৬ শতাংশ। প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগও বেড়েছে; এ সময় এ খাতে এসেছে ৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি।
কিন্তু শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগে উল্টো চিত্র। গত বছর যেখানে নিট বিনিয়োগ ছিল ৫০ লাখ ডলার, এবার তা নেমে গেছে ঋণাত্মক ৪ কোটি ২০ লাখ ডলারে। বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় থাকলেও কিছু দেশীয় গোষ্ঠী ডলার বাইরে পাঠাতে পারছে। এই বৈপরীত্যই আর্থিক ব্যবস্থার ঝুঁকি ও দুর্বলতা নির্দেশ করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রায় ৭৫ শতাংশই ট্রেড-বেসড মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে যাচ্ছে। আমদানি-রফতানির সময় মিথ্যা ঘোষণা, ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মতো পদ্ধতিতে বিপুল অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে এসব তথ্য উঠে আসে। গবেষণাটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, ২০১৫ সালে অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন সংশোধনের পর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর মোট ৯৫টি অর্থপাচারের ঘটনা তদন্তে নেয়। সবগুলোই বাণিজ্যভিত্তিক পাচারের সঙ্গে যুক্ত। এসব ঘটনার আর্থিক পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রমজান ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব:
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ডলার সংকট সামাল দিতে কিছু নীতি শিথিল করা হয়েছে, যাতে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বাধা না থাকে। তার ভাষায়, “আসন্ন পবিত্র রমজানকে ঘিরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এ কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বড় হয়েছে।” তবে অর্থপাচারের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
থামছে না অর্থপাচার:
অর্থপাচার অব্যাহত রয়েছে—এমন চিত্র উঠে এসেছে আর্থিক খাত সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে। তাদের হিসাবে, গত ১৬ বছরে দেশ থেকে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। নতুন অর্থবছরের শুরুতেই ডলারের অস্বাভাবিক বহির্গমন বৈদেশিক খাতে নতুন চাপ তৈরি করেছে।
শ্বেতপত্র কমিটি বলছে, পাচার হওয়া অর্থের বড় অংশ গেছে বিভিন্ন ট্যাক্স হ্যাভেনে। সেখানে অপরাধচক্র বাড়ি কেনা, ব্যবসা স্থাপনসহ নানা বিনিয়োগে এসব অর্থ ব্যবহার করেছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কাজ দ্রুততর করতে সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য সরকারি দফতরগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফার্ম, নজরদারি সংস্থা ও আইনজীবীদের সঙ্গে লবিং চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “অন্তত দেড়শত ব্যক্তির বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করেছে, তাদের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাঠিয়েছেন এবং এসব লেনদেন নজরদারিতে রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মত, নতুন করে অর্থপাচার বন্ধ না হলে পুরোনো অর্থ উদ্ধার কার্যক্রম অর্থহীন হয়ে পড়বে। জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন বলেন, “যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা বলে সব ঠিক আছে কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর অনিয়ম সামনে আসে। তাই পুরোনো অর্থ উদ্ধারের চেয়ে এখনই পাচার বন্ধ করাই বেশি জরুরি।”
অর্থপাচার ঠেকাতে আমদানি নীতিতে কড়াকড়ি:
বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার রোধে আমদানি নীতিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমদানি পণ্যের মূল্য যাচাই থেকে শুরু করে উচ্চমূল্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে সব নিয়ম কঠোরভাবে মানতে হবে। সম্প্রতি আমদানি মূল্যায়ন ও রিপোর্টিংয়ে বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত হওয়ার পর নীতিমালা পর্যালোচনা সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, বেশ কিছু ব্যাংক ঋণপত্র খোলার সময় বা আমদানি চুক্তি করার সময় ঘোষিত মূল্য যথাযথভাবে যাচাই করছে না। এই অবহেলায় অতিমূল্যায়ন (ওভার ইনভয়েসিং) ও অবমূল্যায়নের (আন্ডার ইনভয়েসিং) সুযোগ তৈরি হয়, যা অর্থপাচারের পথ আরও খুলে দেয়।
এ বিষয়ে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, “আমদানির যেকোনো নথি প্রক্রিয়াকরণের আগে ঘোষিত মূল্যের সত্যতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।” ১৫ অক্টোবর জারি হওয়া সার্কুলারে আরও বলা হয়, “বিদেশ থেকে আমদানিতে মূল্য বেশি বা কম দেখানো (ওভার/আন্ডার ইনভয়েসিং) এবং অর্থপাচার রোধে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।” বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে নতুন নিয়ম কার্যকর হয়েছে। প্রতিটি আমদানিতে স্বচ্ছতা, সঠিক মূল্য ঘোষণা ও নিয়ম মেনে চলা এখন বাধ্যতামূলক।
মূল নির্দেশনা:
আমদানির মূল্য ও নথি যাচাই: সব আমদানিতে বাণিজ্যিক নথি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ওআইএমএস-এ রিপোর্ট করতে হবে। ইনভয়েসে দেখানো মূল্য ও চুক্তির তথ্য যথাযথভাবে যাচাই করা বাধ্যতামূলক।
সতর্ক ও স্বচ্ছ নিরীক্ষণ: রফতানিকারক ও আমদানিকারক—উভয়ের জন্য তথ্যভিত্তিক ও স্বচ্ছ নিরীক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যাংকের দায়িত্ব: ব্যাংকগুলোকে দ্রুত তাদের শাখা, ক্লায়েন্ট ও সংশ্লিষ্ট স্টাফদের এই নিয়ম জানাতে হবে। একই সঙ্গে ক্লায়েন্টদের বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
প্রস্তুতি ও প্রয়োগ: এডি ব্যাংকগুলোকে নতুন নিয়ম বাস্তবায়নে প্রস্তুত থাকতে হবে। নিয়ম না মানলে আমদানিতে বাধা তৈরি হতে পারে বা নিরীক্ষণ আরও কঠোর হবে।

