বন্দর উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ আনার পক্ষে সরকারের বেশ কিছু যুক্তি রয়েছে। প্রধান যুক্তি হলো—বিদেশি কোম্পানি এলে বিনিয়োগ বাড়বে, দুর্নীতি কমবে এবং সামগ্রিক সক্ষমতা উন্নত হবে। এসব যুক্তি সামনে রেখে সরকার সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানে কিছু অসংগতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গতকাল একটি অস্বাভাবিক দিনে পরপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। একটি ডেনমার্কের সঙ্গে, আরেকটি সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে। সরকার বলছে, এসব চুক্তি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বন্দর পরিচালনায় সক্ষমতা বাড়াবে। এমনকি এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বড় অবদান বলেও দাবি করা হচ্ছে।
তবে এই চুক্তি করতে গিয়ে কয়েকটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সরকারের অস্বাভাবিক তাড়াহুড়া। যে দিনটি চুক্তির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটিও স্বাভাবিক ছিল না। আরও উদ্বেগের বিষয়—চুক্তির বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না বলে জানানো হয়েছে। কাজের ধরন থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত সব জায়গায় যেন লুকোচুরির ছাপ রয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই বিনিয়োগ দেশের জন্য লাভজনক হবে না ক্ষতিকর হবে—তা নির্ভর করে চুক্তির শর্ত কতটা স্বচ্ছ এবং দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কি না তার ওপর। যে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে আসবে, তাদের জবাবদিহি আছে কি না, তাদের কার্যক্রম অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে কি না—এসব বিষয়ও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বিদেশি বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা নিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক যুক্তি নতুন করে প্রশ্ন তোলে। রামপাল, সুন্দরবন, মাতারবাড়ী, বাঁশখালী, পায়রা ও রূপপুর—প্রতিটি বড় প্রকল্পেই বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। কিন্তু এসব প্রকল্প নদী ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়েছে। কোথাও বাংলাদেশের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা পেয়েছে—এমন উদাহরণ নেই। একইভাবে আদানি চুক্তিও এক বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে করা হয়েছে, যার শর্ত নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
এবার আলোচনায় এসেছে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। নৌপরিবহন উপদেষ্টা ও বিডার চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, এ টার্মিনাল আরও লাভজনক ও দক্ষ করতে বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিতে হবে। কিন্তু কোনো দরপত্র ছাড়াই সরকার সরাসরি সিদ্ধান্ত নিয়ে চুক্তি করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। আবুধাবির যে কোম্পানির হাতে নিউমুরিং টার্মিনাল দেওয়ার কথা হচ্ছে, তার প্রশংসা করে বলা হয়েছে—এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের। তারা নাকি দক্ষতা বাড়াবে, দুর্নীতি কমাবে। কিন্তু বাস্তবে তারা মাশুল বাড়িয়েছে ৪০ গুণ। মুনাফা নিশ্চিত করতে মাশুল বাড়ানোই দুর্নীতির একটি রূপ। বিদেশি কোম্পানিকে বাড়তি লাভ দেওয়ার পথ তৈরি করতেই এই সিদ্ধান্ত—এমন মত বিশেষজ্ঞদের।
টানা মাশুল বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উন্নয়নের নামে এটি প্রয়োজন বলা হলেও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নিজেই একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি খরচের তুলনায় দ্বিগুণ আয় করে। ফলে উন্নয়ন বা সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশি কোম্পানি লাগবে কিংবা মাশুল বাড়াতে হবে—এ যুক্তি টেকসই নয়। দক্ষতার ক্ষেত্রে সমস্যার মূল জায়গা কাস্টমস ও আমলাতন্ত্র। এগুলো অপরিবর্তিত রেখে শুধু অপারেটর পরিবর্তন করলে দক্ষতা বাড়বে—এই দাবি বাস্তবতাবর্জিত। এর পরিণতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানোর লক্ষ্যে। তাদের দায়িত্ব ছিল নির্বাচনকে ভয়মুক্ত রাখা এবং ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য সংস্কারের পথরেখা তৈরি করা। দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা, সক্ষমতা বাড়ানোর উপায় নির্ধারণ করা এবং জাতীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নের সুপারিশ করাই হওয়া উচিত ছিল তাদের মূল কাজ। কিন্তু তারা এসব কিছুই করেনি। বরং সামগ্রিকভাবে জাতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, অথচ দুর্নীতির প্রকৃত উৎস ও দায়ীদের শনাক্ত করা হয়নি। দুর্নীতি শুধু বন্দরে সীমাবদ্ধ নয়; এর শিকড় সচিবালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। তবুও যেসব চুক্তি করা হয়েছে, তা বিদেশি লবিস্ট ও কমিশনভোগীদের প্রভাবেই হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এসব পদক্ষেপ দেশের স্বার্থের পরিপন্থী এবং একটি আত্মহীনতা তৈরি করছে যে, বাংলাদেশ নিজে কিছু করতে সক্ষম নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে। তবু যদি একটি বন্দরও নিজস্ব সক্ষমতায় পরিচালনা করা না যায়, তাহলে এই স্বাধীনতার অর্থ কোথায়—এ প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। দেশে দেড়শর মতো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার পরও যদি আমরা একটি বন্দর পরিচালনার দক্ষতা গড়ে তুলতে না পারি, তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
মন্ত্রণালয়গুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু সেক্ষেত্রে কি সমাধান হবে—সব মন্ত্রণালয় বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া? বর্তমান যুক্তির বিন্যাস এমনই ইঙ্গিত দেয়। জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যেসব কূটতর্ক উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা দেশের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। অথচ প্রয়োজন ছিল জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে চলা। এই সক্ষমতার ভিত্তিতেই টেকসই গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব।
অন্তর্বর্তী সরকার সে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তারা সেই পথে না গিয়ে উল্টো পথে হাঁটছে। পরবর্তী ৩০ থেকে ৪০ বছরের জন্য যে বিদেশি চুক্তিগুলো করা হচ্ছে, তার নেতিবাচক প্রভাব জনগণ ও অর্থনীতি দীর্ঘদিন ভোগ করবে। আর তখন এসব সিদ্ধান্তের জবাবদিহি চাওয়ার মতো কাউকেই পাওয়া যাবে না—এ আশঙ্কাই এখন বড় হয়ে উঠছে।
সূত্র: সমকাল

