দেশে এক হাজার আবেদনের বিপরীতে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে একাই ২০টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ নিয়মিত করতে চেয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ।
এদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়তে বাড়তে ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এই খেলাপি ঋণ কমাতে চলতি বছরের শুরুতে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব আবেদনের তালিকায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সব ঋণ নেই। অনেকেই কেবল আংশিক ঋণ নিয়মিত করতে চান। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুযোগ দিলেও বাস্তবে অনেক ব্যাংকই সেই সুবিধা দিতে আগ্রহী নয়।
খেলাপি ঋণের উল্লম্ফনের পর গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নেয়। কোনো নীতিমালা জারি না করে শুরুতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটির মাধ্যমে আবেদন গ্রহণ শুরু হয়। কমিটি মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়। তবে নির্দিষ্ট সার্কুলার ছাড়া কমিটির মাধ্যমে এ ধরনের সুবিধা দেওয়ায় প্রশ্ন ওঠে। এমনকি অনৈতিক প্রক্রিয়ায় তালিকায় নাম তোলার অভিযোগও পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরাসরি গ্রাহকের আবেদন নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব নয়। বিশেষ বিবেচনায় এমন পুনঃতফসিল করে দেওয়ার চেষ্টা থেকে অনৈতিক পদক্ষেপের অভিযোগও ওঠে। এ কারণে গত সেপ্টেম্বরে একটি সার্কুলার জারি করে বিশেষ পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রথম সার্কুলারে বলা হয়, জুন পর্যন্ত খেলাপি হওয়া ঋণে এই সুবিধা পাওয়া যাবে। পরে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আরেকটি সার্কুলার জারি করে জানানো হয়, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণে বিশেষ সুবিধার জন্য আবেদন করা যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, এভাবে খেলাপি ঋণ কমানো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তার মতে, ‘টোটকা দাওয়াই’ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধান হয় না। গত জানুয়ারিতে গঠিত যাচাই–বাছাই কমিটির কাছে এক হাজার ৪০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি আবেদনে চাওয়া হয় ৫৫ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার পুনঃতফসিল। এককভাবে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার পুনঃতফসিল চেয়েছে মাগুরা গ্রুপ। এই ঋণ রয়েছে আট ব্যাংক ও তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।
এস আলম গ্রুপের ১২ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকার পুনঃতফসিলের আবেদন করেছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। আবেদনটি এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে করা হয়নি, বরং ব্যাংক নিজেই করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতে কোনো সাড়া দেয়নি। তৃতীয় সর্বোচ্চ পুনঃতফসিল চেয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তাদের আবেদন ১১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকার। এই ঋণ ছড়িয়ে রয়েছে ২৮ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ ৯ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা নিয়মিত করতে চেয়েছে। গ্রুপটির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মো. সাইফুল আলম এ আবেদন জমা দেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি, শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ছয় হাজার ৯১৯ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করা হয়েছে। আবেদনটি করেছেন গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী। গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের পর থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদার ও সালমান এফ রহমান কারাগারে আছেন। ঋণ পুনঃতফসিলের তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত গ্রুপ। গ্রুপটির ঋণ রয়েছে ২৮ ব্যাংকে, মোট ছয় হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। এই ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
জিপিএইচ ইস্পাতের ঋণ খেলাপি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কোম্পানির সচিব মো. মোশারফ হোসেন জানান, তাদের ঋণ নিয়মিত রয়েছে। তবে করোনাভাইরাস ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিনিময় হারজনিত লোকসান বেড়েছে। এতে আর্থিক চাপ তৈরি হয়েছে। তাই পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় চাওয়া হয়েছে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে বহু বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সাদ মুসা গ্রুপও পুনঃতফসিলের তালিকায় রয়েছে। তারা মোট পাঁচ হাজার ১০০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেছে। এর মধ্যে নিজ নামে ১৬ ব্যাংক ও ছয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এছাড়া দুই ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেনামি ৬০০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল চাওয়া হয়েছে।
অষ্টম অবস্থানে থাকা ওপেক্স–সিনহা গ্রুপ চার হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেছে। পরিমাণের দিক থেকে নবম অবস্থানে রয়েছে আনোয়ার গ্রুপ। তারা ৩০ ব্যাংকে চার হাজার ১৮৬ কোটি টাকার পুনঃতফসিল চেয়েছে। ইসলামী ব্যাংকে নাবিল গ্রুপের পুনঃতফসিলের আবেদন চার হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের এক হাজার ৩৮৪ কোটি, আনোয়ার ফিড মিলসের এক হাজার ১৭৫ কোটি, নাবিল গ্রেইন গ্রুপসের ৯৪০ কোটি এবং নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ৬৬২ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করার আবেদন করা হয়েছে।
পরিমাণ বিবেচনায় তালিকার ১১ নম্বরে রয়েছে পারটেক্স। তারা ২০ ব্যাংকে চার হাজার ৬২ কোটি টাকার বিশেষ পুনঃতফসিল চেয়েছে। এর মধ্যে পারটেক্স গ্রুপের বকেয়া দুই হাজার ২০০ কোটি এবং পারটেক্স স্টার গ্রুপের এক হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে গোল্ডেন সন। তারা ১০ ব্যাংকে তিন হাজার ৮৭৪ কোটি টাকার পুনঃতফসিল চেয়েছে। প্রভিটা গ্রুপ ২৩ ব্যাংকে তিন হাজার ৪০৬ কোটি, রুবি ফুড প্রোডাক্ট ১৩ ব্যাংকে তিন হাজার ৩৫৭ কোটি এবং আহসান গ্রুপ ১২ ব্যাংকে তিন হাজার ২৮ কোটি টাকার পুনঃতফসিলের আবেদন করেছে।
ধারাবাহিকভাবে ১৬ নম্বরে রয়েছে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল, যাদের পুনঃতফসিল আবেদন দুই হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। মেজর (অব.) মান্নানের সানম্যান গ্রুপ চেয়েছে দুই হাজার ৫৪১ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করতে। আব্দুল মোনেম গ্রুপ ২২ ব্যাংকে দুই হাজার ৫১১ কোটি, ডার্ড গ্রুপ সাত ব্যাংকে দুই হাজার ২১৫ কোটি এবং জেএমআই গ্রুপ ১১ ব্যাংকে দুই হাজার ২০১ কোটি টাকার পুনঃতফসিলের আবেদন করেছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু আবেদন নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে। কিছু আবেদন নাকচ করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুবিধা অনুমোদন করলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সেই সুবিধা দিচ্ছে না।
জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নিয়মিত করার অনুমোদন দিলেও অনেক ব্যাংক সেই নির্দেশ মানছে না। এতে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছেন। বিগত সরকারের সময়ে আড়ালে থাকা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এটি সর্বোচ্চ হার।
গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসেবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা, অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। খেলাপি ঋণ বাড়লে ঋণের মান কমে যায় এবং ব্যবসা–বাণিজ্যে নানা জটিলতা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে বিশেষ বিবেচনায় খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে এই কঠোরতা যাতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ক্ষতির কারণ না হয়, সে জন্যই বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

