জলবায়ু অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বাধ্যতামূলক রোডম্যাপ ছাড়া বেলেম চুক্তি (কপ–৩০) মূল লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে বাধ্যবাধকতা না রেখে স্বেচ্ছায় কমানোর আহ্বান মূলত বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের মূল কারণকে আড়াল করার চেষ্টা।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার মতো বাস্তবসম্মত কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পৃথিবী এখন তিন ডিগ্রি উষ্ণতার ঝুঁকির দিকে দ্রুত এগোচ্ছে। এ অবস্থায় ২০৩০ সালের ট্রিপল অভিযোজন অর্থায়ন লক্ষ্য ২০৩৫ সালে ঠেলে দেওয়া উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল বলেও মন্তব্য তাদের। তারা মনে করেন, উন্নত দেশগুলোর লক্ষ্য সহযোগিতা নয়, বরং জলবায়ু অর্থায়নকে নতুন ধরনের ঋণের বোঝা তৈরি করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরণের পদক্ষেপ বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর টিকে থাকার সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের পরামর্শ, এমন দেশে বাহ্যিক সহায়তার অপেক্ষায় না থেকে নিজস্ব সম্পদে শক্তিশালী স্থানীয় অভিযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত।
জলবায়ু অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বাধ্যতামূলক রোডম্যাপ ছাড়া বেলেম চুক্তি (কপ–৩০) কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, স্বেচ্ছায় জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর আহ্বান মূল সংকট থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা না থাকায় বিশ্ব এখন তিন ডিগ্রি উষ্ণতার ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে। প্রস্তাবিত ট্রিপল অভিযোজন অর্থায়ন লক্ষ্য ২০৩০ সাল থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া উন্নত বিশ্বের দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল। তাদের লক্ষ্য সহযোগিতা নয়, বরং জলবায়ু অর্থায়নকে ঋণ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর টিকে থাকার সংকট আরও বাড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, বাহ্যিক সহায়তার অপেক্ষায় না থেকে নিজস্ব সম্পদে শক্তিশালী স্থানীয় অভিযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন জরুরি। এই বাস্তবতা তুলে ধরে গতকাল সোমবার ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘কপ–৩০-এর ফলাফল এবং বাংলাদেশে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জলবায়ু সংরক্ষণ ও পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন এবং বেলেম চুক্তি ব্যর্থ হওয়া প্রসঙ্গে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কোস্ট ফাউন্ডেশন, কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিপিডি), সেন্টার ফর পার্টিসেপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি), ইক্যুইডিবিডি, সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম (বিসেজেএফ) এবং ওয়াটার্স কিপার্স বাংলাদেশ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইক্যুইডিবিডির চিফ মডারেটর ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এম রেজাউল করিম চৌধুরী।
এতে কপ–৩০ সম্মেলনে অংশ নেওয়া অনেকেই বক্তব্য দেন। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর হাসান মাসুম, সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী সামসুদ্দোহা, ওয়াটার্স কিপার্স বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী শরীফ জামিল, বিসেজেএফের সভাপতি কাউসার রহমান ও সম্পাদক মোতাহার হোসেন, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের নিখীল চন্দ্র ভদ্র, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী ও সাংবাদিক সালাহউদ্দিন বাবলুসহ অনেকে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের এম এ হাসান।
সংবাদ সম্মেলনে এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বরাবরের মতো এবারও এলডিসি ও এমভিসিভুক্ত দেশগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট আর্থিক প্রতিশ্রুতি আসেনি। ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। যা আসে তাও সামান্য অনুদান, মূল অংশ থাকে ঋণনির্ভর। ন্যায়ভিত্তিক জলবায়ু ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশকে অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সঙ্গে এক হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং, অ্যাডভোকেসি ও আলোচনায় শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের বড় জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় নিজস্ব সম্পদে শক্তিশালী স্থানীয় অভিযোজন কাঠামো গড়ে তুলতেই হবে।’
সামসুদ্দোহা বলেন, ‘৫৯টি অনুচ্ছেদের চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকার আমরা পাইনি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কোনো সিদ্ধান্তও আসেনি, শুধু আলোচনার কথাই বলা হয়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে সম্মেলনের মূল আলোচনার বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। ব্রাজিলের নেতৃত্বে তৈরি নতুন তহবিল ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ফরেভার ফ্যাসিলিটি তারই উদাহরণ। এটি এক ধরনের ঋণ তৈরির হাতিয়ার। আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনের সম্মেলনে মূল দায়িত্ব থাকে সরকারের প্রতিনিধিদের। তাই দক্ষ প্রতিনিধিত্বের ওপর আরও জোর দিতে হবে।’
ওয়াটার্স কিপার্স বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী শরীফ জামিল বলেন, ‘যদি জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত না হয়, তাহলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কিভাবে ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেই এনডিসি–০৩ জমা দেয়নি, অথচ তারা এনডিসি পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করছে। বিষয়গুলো হাস্যকর। সম্মেলনের সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে অর্থায়নের ক্ষেত্রে কোনো তাৎপর্য বহন করে না, কারণ এর কোনো নির্দিষ্ট ভিত্তি নেই।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর হাসান মাসুম বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির বিষয়ে আলোচনা এবারে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জ্বালানি লবিষ্টদের প্রভাবে জলবায়ু আলোচনা অধিকারভিত্তিক না হয়ে করপোরেটভিত্তিক হয়ে গেছে। পুরো প্রক্রিয়াটি আমলাতান্ত্রিকভাবে চলে।’
বিসেজেএফের সভাপতি কাউসার রহমান বলেন, ‘সময় এসেছে জলবায়ু ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করে সম্মেলন প্রক্রিয়া সংস্কার করার।’ বিসেজেএফের সম্পাদক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানি ধাপে ধাপে বন্ধ করা এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কাঠামো তৈরি করার দাবি অব্যাহত রাখতে হবে।’
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, ‘প্রথমেই নিজেদের জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে।’ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কার্বন ট্রেডিং থেকে প্রত্যাশিত সুফল কখনও আসবে না; এটি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।’
কোস্ট ফাউন্ডেশনের এম এ হাসান বলেন, ‘জলবায়ু অর্থায়নের সিংহভাগই আসে ঋণ হিসেবে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, জলবায়ু অর্থায়নের জন্য প্রতি পাঁচ ডলার দেওয়ার বিপরীতে পরিশোধ করতে হচ্ছে সাত ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু জলবায়ু ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ৮০ ডলার। তাই ঋণভিত্তিক পরিকল্পনা থেকে সরে আসা এবং নিজস্ব অর্থায়ন বাড়াতে ব্লু-ইকোনোমির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।’

