দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, রিজার্ভও আগের তুলনায় শক্ত অবস্থানে। কিন্তু স্বস্তির এ ছবির আড়ালেই লুকিয়ে আছে পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ—যেগুলোর সমাধান না হলে পুনরুদ্ধারের গতি থমকে যেতে পারে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই বাস্তবতা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগে স্থবিরতা, রাজস্ব সংগ্রহে ঘাটতি, আমদানি–রপ্তানির অনিশ্চয়তা, টাকার মূল্যমানের ওঠানামা এবং সরকারি খাতে অতি–ঋণনির্ভরতা—এই পাঁচ ঝুঁকিই এখন অর্থনীতির মাথাব্যথার কারণ।
অক্টোবরের তথ্য বলছে, খাদ্যের দাম কমায় সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নেমে এসেছে। চালের সরবরাহ বেড়েছে, নতুন আমন বাজারে এসেছে, সরকারি কেনাকাটাও দাম কমাতে সহায়তা করেছে। এতে খাদ্যখাতে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৭ শতাংশের ঘরে। তবে বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন—অখাদ্য খাতের চাপ কিন্তু বাড়ছে, যেখানে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে।
চালের দামই অক্টোবরের খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। অন্যদিকে শাকসবজির ভালো সরবরাহ চাপ কমিয়েছে; পেঁয়াজ–আলুর দামও নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে বাজার কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।
কিন্তু অন্যদিকটি ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। ব্যাংকে আমানত বাড়লেও, ব্যবসায় ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমছে। সেপ্টেম্বরে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ শতাংশের কাছাকাছি—প্রায় চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সুদের উচ্চহার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যবসায়িক ঝুঁকি এই ধীরগতির প্রধান কারণ। বিপরীতে সরকারি খাতে ঋণের ব্যবহার বেশ দ্রুত বাড়ছে, যা বেসরকারি খাতে চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ব্যাংক খাতে আরেকটি সমস্যা হলো সুদহারের ব্যবধান। বিদেশি ব্যাংকগুলোর সুদহার দেশের ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি—৯ শতাংশের কাছাকাছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ পরিমাণের খেলাপি ঋণ, যা নতুন বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।
রাজস্ব সংগ্রহের অবস্থাও নাজুক। অক্টোবর মাসে লক্ষ্য থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি কম আয় হয়েছে। অর্জনের হার মাত্র ৭৭ শতাংশ। আমদানি–রপ্তানি, ভ্যাট, আয়কর—সব খাতেই ঘাটতি। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এমন হারে রাজস্ব সংগ্রহ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।
এদিকে উন্নয়ন ব্যয়েও অগ্রগতি খুব উৎসাহজনক নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়ন দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি। বরাদ্দ কমা ছাড়া বাস্তব উন্নতির বড় কোনো ইঙ্গিত নেই বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
যদিও কিছু সূচক স্বস্তি দিচ্ছে। রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে, অক্টোবর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি—বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রেমিট্যান্সেও এসেছে ইতিবাচক সাড়া। জুলাই থেকে অক্টোবর—প্রতিটি মাসেই এসেছে আগের বছরের তুলনায় বেশি অর্থ। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে প্রবাহ ছিল শক্তিশালী।
তবে রপ্তানিতে ওঠানামা চিন্তার কারণ। কিছু মাসে বড় ধস, আবার কিছু মাসে ঘুরে দাঁড়ানো—এই অস্থিরতা এখনও কাটেনি। জুলাইয়ে রপ্তানি ৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার পৌঁছালেও পরের মাসগুলোতে গতি ছিল অনিশ্চিত।
সব মিলিয়ে, অর্থনীতি কিছুটা স্বস্তি পেলেও সামনে যে পথ দাঁড়িয়ে আছে, তা মোটেও সহজ নয়। পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলেই প্রকৃত পুনরুদ্ধার নিশ্চিত হবে—এমন মত জিইডির।

