স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে রপ্তানি কাঠামো বদলাতে হবে। ভর্তুকিনির্ভর নীতি থেকে বের হয়ে উদ্ভাবন, উৎপাদনশীলতা এবং হাইটেক শিল্পে জোর দেওয়ার সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি। তাদের মতে, উত্তরণের পর নগদ প্রণোদনা আর দেওয়া যাবে না। তাই রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে নীতি পরিবর্তন জরুরি। কমিটির সুপারিশের নথি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পর্যালোচনা করেছে।
কমিটি বলছে, চীনের “মেইড ইন চায়না ২০২৫” ও ইন্দোনেশিয়ার “মেকিং ইন্দোনেশিয়া ৪.০” উদ্যোগ বাংলাদেশ অনুসরণ করতে পারে। চীন এই কর্মসূচি চালু করে উৎপাদন খাত আধুনিকীকরণ, বিদেশি প্রযুক্তিনির্ভরতা কমানো এবং হাইটেক শিল্পে নেতৃত্ব নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছিল। এ উদ্যোগে স্বল্পসুদের ঋণ, কর ছাড়, ভর্তুকিযুক্ত জমি, ছাড়কৃত মূল্যে ইস্পাত ও সাশ্রয়ী ইউটিলিটি সুবিধা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়া ২০১৮ সালে শিল্পখাতে অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নে “মেকিং ইন্দোনেশিয়া ৪.০” রোডম্যাপ চালু করে। সেখানে নিয়মকানুন সহজীকরণ, শিল্পাঞ্চল সম্প্রসারণ এবং লজিস্টিকস উন্নয়নে বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
চীন ও ইন্দোনেশিয়ার পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশও মূল্য সংযোজন বাড়াতে, নতুন প্রযুক্তি আনতে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি গ্রহণে এবং নতুন পণ্য উদ্ভাবনে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে বলে কমিটি মনে করে। গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) কর সুবিধার কথাও বলা হয়েছে। উচ্চ প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠানকে কম করহার, সার্ভিসড ল্যান্ড বরাদ্দসহ বিভিন্ন নীতিগত সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি চামড়া, পাট, কৃষিপণ্য ও ওষুধশিল্পকে নগদ সহায়তার বদলে উৎপাদনশীলতা–ভিত্তিক নীতির আওতায় শক্তিশালী করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি এবং ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও চীনের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করেই এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কমিটি বলছে, নগদ প্রণোদনার বিকল্প হিসেবে ডব্লিউটিও–সম্মত সুবিধা চালু করলে রপ্তানি খাত চাপ সামলাতে পারবে।
২০ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে ১৭ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, বাণিজ্য সচিব, শিল্প সচিব, কৃষি সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার শীর্ষ নির্বাহীরা। তারা আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রয়োজন হলে নতুন সুবিধার প্রস্তাব দেবেন।
বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ পরিকল্পনা
আঙ্কটাডের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হবে। তিনটি মানদণ্ডই ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে। উত্তরণ–পরবর্তী সময় নগদ প্রণোদনা নিষিদ্ধ হওয়ায় সরকার ধীরে ধীরে তা তুলে নিচ্ছে। বর্তমানে ৪৩টি খাত যেসব নগদ সহায়তা পায়, আগামী জানুয়ারিতে তার অর্ধেক এবং আগামী জুলাই থেকে পুরো সহায়তাই বন্ধ হয়ে যাবে। গত বছরও দুই দফায় প্রণোদনা কমানো হয়েছে।
চলতি বাজেটে রপ্তানি প্রণোদনায় বরাদ্দ ৯,০২৫ কোটি টাকা। আগের বছরও বরাদ্দ একই ছিল। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৮,১৯৮ কোটি টাকা।
এদিকে, এলডিসি উত্তরণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ‘স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্যাটেজি’ (STS) বাস্তবায়ন শুরু করেছে। তবে গ্যাস–বিদ্যুৎ সংকট, অবকাঠামো–দুর্বলতা, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ীরা গ্রাজুয়েশন তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। সরকার তা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিডিপির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২৯ সালের পর রপ্তানিতে যাতে সমস্যা না হয়, সেজন্যই এসটিএস বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বিবেচনায় অতিরিক্ত তিন বছর সময় পেলে তা যৌক্তিক হতো।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ চৌধুরী বলেন, উত্তরণের পরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, কানাডা ও জাপান তিন বছর জিএসপি সুবিধা দেবে। এসব বাজারে দেশের ৯৩ শতাংশ রপ্তানি যায়। তাই ২০২৬ সালে গ্রাজুয়েশন হলেও ২০২৯ সাল পর্যন্ত বড়ধরনের প্রভাব পড়বে না।
শুল্ক–ছাড়, স্বল্পসুদের ঋণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের সুপারিশ
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে রপ্তানি বাড়াতে কমিটি স্বল্পসুদের ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সুদের হার হতে পারে ব্যাংক রেট +২.৫ শতাংশ। ট্যানারি শিল্পে ব্যবহৃত কেমিকেলে বর্তমানে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ককর রয়েছে। কমিটি মনে করে, শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নামানো গেলে উৎপাদন ব্যয় কমবে। এক্সপোর্টার্স রিটেনশন কোটা ২৫ হাজার ডলার থেকে বাড়ানোর পরামর্শও রয়েছে।
চামড়া কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলে ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি শিল্পটির জন্য কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি কারখানা যৌথভাবে ১০ হাজার বর্গফুটের ক্রোম রিকভারি প্ল্যান্ট স্থাপন করলে প্রক্রিয়াজাত খরচ কমবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে স্বল্পসুদের ঋণ দেওয়া যেতে পারে।
ঈদুল আজহায় পাওয়া প্রায় এক কোটি পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে প্রচুর কেমিকেল লাগে। কমিটি বলেছে, এসব রাসায়নিক ডিউটি–ফ্রি সুবিধায় আমদানির সুযোগ দেওয়া উচিত।
এ ছাড়া ভিয়েতনাম ও চীনের মডেল অনুসরণ করে ভ্যালু–ইন/ভ্যালু–আউট ব্যবস্থায় বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা চালুর প্রস্তাব রয়েছে। ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের জন্য কমন বন্ডেড ওয়্যারহাউস গড়ার কথা বলা হয়েছে।
পাটখাতে সোর্স ট্যাক্স প্রত্যাহার, শুল্কারোপ ও বীজ উন্নয়নের পরামর্শ
কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি পাট কিনলে ১ শতাংশ সোর্স ট্যাক্স দিতে হয়। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। কমিটি বলছে, এই কর প্রত্যাহার করলে রাজস্বে খুব কম প্রভাব পড়বে, কিন্তু উৎপাদক ও রপ্তানিকারক লাভবান হবেন।
ভারত বাংলাদেশি পাটপণ্যে অ্যান্টি–ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করলেও কাঁচা পাট আমদানি করছে। তাই কাঁচা পাট রপ্তানিতে ১৫–২০ শতাংশ শুল্কারোপ করলে দেশীয় পণ্যের চাহিদা বাড়বে এবং শুল্ক আয়ও বাড়বে।
ভালো জাতের বীজ উৎপাদন বাড়ানো এবং স্বল্পমূলে কৃষকদের সরবরাহ করার সুপারিশ করা হয়েছে। বহুমুখী পাটপণ্যের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে সরকারের আর্থিক অংশগ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। কমিটি পাটখাতে স্বল্পসুদের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে জুট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট ফান্ড গঠনের প্রস্তাব করেছে।
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে হিমাগার, রিফার ভ্যান ও আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবের প্রয়োজন
ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং রপ্তানি বাড়াতে মাল্টি–টেম্পারেচার হিমাগার স্থাপনের ওপর জোর দিয়েছে কমিটি। সরকারি উদ্যোগে অথবা স্বল্পসুদের অর্থায়ন দিয়ে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করে এসব হিমাগার স্থাপন করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ বিলেও ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যে রিফার ভ্যান, বন্দরভিত্তিক রেফ্রিজারেটেড ওয়্যারহাউস, ইলেকট্রনিক ডেটা লগার ও টাইম–টেম্পারেচার ইন্ডিকেটর ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে।
ভারত আন্তর্জাতিক খাদ্যমেলায় অংশ নেওয়া উদ্যোক্তাদের ভ্রমণ ব্যয় বহন করে এবং ই–কমার্স বিক্রিতেও সহায়তা দেয়। বাংলাদেশও একই ধরনের সুবিধা দিতে পারে বলে কমিটি মনে করে।
এ ছাড়া কৃষিপণ্যের বেশিরভাগ পরীক্ষাই বাংলাদেশে করা যায় না, বা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সরকারি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন টেস্টিং ল্যাব স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
ওষুধশিল্প: প্রি–ফাইন্যান্সিং বাড়ানো, এপিআই পার্ক চালু ও গবেষণায় জোর
ওষুধশিল্পে এক্সপোর্ট ফ্যাসিলিটেশন প্রি–ফাইন্যান্সিং স্কিম ৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
২০০৮ সালে শুরু হওয়া মুন্সিগঞ্জ এপিআই পার্কের কারখানাগুলো গ্যাস না থাকায় উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। কমিটি বলেছে, দ্রুত পার্ক কার্যক্রম শুরু করে গ্যাসসহ সব ইউটিলিটি নিশ্চিত করতে হবে।
এপিআই উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্কিম ২ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় এমন স্কিম চালু রয়েছে।
নিয়ন্ত্রিত বাজারে প্রবেশের জন্য দেশেই বায়ো–ইকুইভ্যালেন্স ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে সক্ষম কনট্রাক্ট রিসার্চ সেন্টার স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে এসব পরীক্ষা বিদেশে করতে হয়, যা ব্যয়বহুল।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি ডব্লিউএইচও স্বীকৃত হলেও এপিআই পরীক্ষা করতে পারে না। আধুনিক ল্যাব সরঞ্জামে বিনিয়োগ করলে ব্যয় কমবে, আস্থা বাড়বে এবং বৈশ্বিক বাজারে অবস্থান শক্ত হবে।
উত্তরণের পর বাংলাদেশ আর পেটেন্টকৃত ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে না। তাই এখন থেকেই গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি বলে কমিটি মনে করে।

