বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে যে পঞ্চমূল চ্যালেঞ্জ সবচেয়ে বড় বাধা তৈরি করছে, তা স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—বিডা। সংস্থাটির সাম্প্রতিক বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচটি সমস্যা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে। এগুলো হলো সেবার নিম্নমান, দুর্নীতি, নীতির অস্থিতিশীলতা, পরামর্শ ছাড়া নীতিনির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় রিসোর্সের অনিশ্চয়তা।
প্রতিবেদন বলছে, এসব চ্যালেঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসতে বিডা চারটি দিককে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ও কার্যকর সমন্বয়, বিনিয়োগ নীতি ও সেবার আধুনিকায়ন, বিনিয়োগ আকর্ষণের নতুন উদ্যোগ এবং খাতভিত্তিক উন্নয়ন ও অবকাঠামো কৌশল। বিডা জানিয়েছে, প্রতিটি বিষয়ে আলাদা বিশ্লেষণ ও তথ্য প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের ধারণা, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিডা কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংলাপে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। এতে দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতের অর্ধ শতাধিক ব্যবসায়ী নেতা ও শিল্প উদ্যোক্তা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিক, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান এবং বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।
আলোচনায় বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশে দেশি উদ্যোক্তা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মতামত একই জায়গায় মিলে গেছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়তে এখনো অনেক সুযোগ আছে। তাই এ বছরের শুরুতে প্রায় ২০০ দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে বৈঠকে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তিনি জানান, বিনিয়োগ নীতির স্থিতিশীলতা, সরকারি সেবার গতি বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি নির্মূলের দাবি প্রায় সব আলোচনাতেই উঠে এসেছে। এসব যৌক্তিক দাবি মাথায় রেখে বিডা বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক উদ্যোগের ফল দ্রুত মিলছে। আর কিছু পরিবর্তন দীর্ঘ মেয়াদে পুরো ব্যবস্থাকে আধুনিক করবে। আশিক চৌধুরী আরও বলেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশের লক্ষ্য সরকারের জবাবদিহি আরও শক্ত করা। দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশে সবচেয়ে অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ গড়তে বিডা দৃঢ়ভাবে কাজ চালিয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না এবং গ্যাস–বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন না, তারাই দেশে বড়লোক হিসেবে পরিচিত। তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন উপস্থিত ব্যবসায়ী নেতারা। ব্যবসায়ীদের দাবি, টাকা পাচার বা বিত্তবান শ্রেণির প্রসঙ্গে শুধু ব্যবসায়ীদের দিকে আঙুল তুললে চলবে না, আমলাদের সম্পৃক্ততাও রয়েছে।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, দেশের বেসরকারি খাত দীর্ঘদিন ধরে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর মাধ্যমে বেড়ে উঠেছে, যেখানে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কই ছিল ব্যবসা বিস্তারের মূল ভিত্তি। তিনি বলেন, দেশে বড়লোক হিসেবে বিবেচিত হন তাঁরা, যারা ব্যাংকের ঋণ শোধ করেন না এবং গ্যাস–বিদ্যুৎ বিল দেন না। তবে এই পরিস্থিতির জন্য তিনি বেসরকারি খাতকে দায়ী করেননি। তাঁর মতে, পুরো ব্যবস্থাটিই ছিল এমন। তিনি আরও বলেন, প্রকৃত ব্যবসায়ীরা মূলত পণ্য উৎপাদন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমেই সম্পদ গড়ে তোলেন। বেসরকারি খাতের জন্য সরকার আরও সুযোগ তৈরি করবে বলেও জানান তিনি। বক্তব্য শেষে তিনি অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন।
এর আগে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, উপদেষ্টা থাকলে সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানানো যেত। তিনি বলেন, দেশে বিত্তবান শুধু ব্যবসায়ীরা নন, আমলারাও হয়েছেন এবং টাকা পাচারে আমলাদের সম্পৃক্ততা বেশি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ব্যবসায়ীরা অন্যদের করা চুরি বা দুর্নীতির দায় নেবেন না। যারা গ্যাস–বিদ্যুৎ চুরি করেন বা টাকা পাচার করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাসিম মঞ্জুর অগ্রিম ও উৎসে করকে ‘সন্ত্রাসী’ ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এআইটি ও টিডিএস এখন ‘ট্যাক্স টেররিজম’-এ পরিণত হয়েছে। লাভ–লোকসান যাই হোক, ব্যবসায়ীদের সব সময় কর দিতে হচ্ছে। কখনো কখনো লোকসান বেশি হলেও কর দিতে হয়েছে বেশি। তিনি বলেন, এনবিআরের কিছু সংস্কারে যেমন বন্ড অটোমেশন ও এইচএস কোডের জটিলতা দূর হয়েছে, তেমনি এখন এআইটি ও টিডিএসের চাপ থেকেও মুক্তি চান ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের উদ্দেশে তিনি বলেন, বর্তমান উচ্চ সুদহার ব্যবসায়ীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং বিশেষ করে ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাঁর মতে, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বিদেশি উন্নয়ন অংশীদারদের কথায় চলাই সমাধান নয়।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বড় বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তাঁর অভিযোগ, দেশের বড় ঋণখেলাপিরা দেশে–বিদেশে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমনকি বড় বড় কথাও বলছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকারের নানা বাধা থাকে, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের তো এমন কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তাই তাঁদের কাছ থেকে কঠোর পদক্ষেপের প্রত্যাশা ছিল। তিনি বলেন, অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, এখন অন্তত কিছু উদাহরণ রেখে যাওয়া উচিত যাতে সবাই বুঝতে পারে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা তুলে ধরে তপন চৌধুরী বলেন, অনেক গ্রাহক এখনো তাদের জমা রাখা টাকা ফেরত পাননি। দুর্বল ইসলামিক ব্যাংকগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে অন্যান্য দুর্বল ব্যাংকের বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন ও সমালোচনার জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় ব্যবসায়ীদের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানো হয়েছিল, যার ফল অর্থনীতির জন্য ভালো হয়নি। অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। তাঁর বক্তব্য, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে আইনগত প্রক্রিয়াও চালাতে হবে।
গভর্নর আরও বলেন, যারা অর্থ পাচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে বহু মামলা করা হয়েছে। এসব এখন আদালতের বিষয় এবং আদালতের কাজকে প্রভাবিত করার সুযোগ নেই। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার কাজ চলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

