রমজানকে ঘিরে দেশের বাজারে আবারও আমদানির চাহিদা দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। ভোগ্যপণ্যের আগাম আমদানির চাপ বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের চাহিদা হঠাৎ করেই তীব্র হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে নতুন করে ডলার কেনা শুরু করেছে—যা নিয়ে আমদানিকারকদের মধ্যে অস্বস্তি আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, মাত্র এক সপ্তাহে দুটি নিলামের মাধ্যমে ১৮৬ মিলিয়ন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই ডলারগুলো কিনা হয়েছে আন্তঃব্যাংকের গড় মূল্যের চেয়েও বেশি দামে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যা, বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দাম স্থিতিশীল রাখতেই তারা ডলার কিনছে। কিন্তু আমদানিকারকরা একে ভিন্নভাবে দেখছেন। তাদের অভিযোগ, চাহিদা যখন এমনিতেই বেশি, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনা বাজারে উল্টো সংকেত দিচ্ছে—ডলারের জোগান কমে গিয়ে দাম আরও বাড়ার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি আমদানি ব্যয় এবং শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতিতে পড়বে।
গত মে মাসে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বাজারভিত্তিক বিনিময়হার চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ব্যাংকগুলো নিজেরাই চাহিদা-জোগানের ওপর ভিত্তি করে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারদামের ঊর্ধ্বগতির পেছনে প্রধান কারণ হলো এলসি খোলার ফের বৃদ্ধি। দীর্ঘ ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে যে কঠোরতা ছিল, সেটি কিছুটা শিথিল হয়েছে। আবার রমজান সামনে রেখে অতিরিক্ত খাদ্যপণ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানির প্রবণতা বেড়েছে।
চট্টগ্রামের একটি শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, “রমজানের আগে ডলারের চাহিদা বাড়বে—এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ঠিক এই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনতে শুরু করলে আমাদের চাপ দ্বিগুণ হয়ে যায়। তখন ব্যাংকগুলো দাম বাড়ানোর সুযোগ পায়। বছরের শেষে তো তারা এমনিতেই বাড়তি মুনাফার চেষ্টা করে।”
তার মতে, এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে আমদানিকারকরা বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই নীতিনির্ধারকদের আরও সতর্ক ও সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান অবশ্য ভিন্ন মত দেন। তিনি জানান, “আমরা কোনোভাবেই দাম কৃত্রিমভাবে বাড়াচ্ছি না। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ডলার ছিল, নিলামের মাধ্যমে শুধু তাদের কাছ থেকেই কেনা হচ্ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স—দুই দিকেই ভালো প্রবৃদ্ধি থাকায় বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। তাই স্থিতিশীলতার জন্য সীমিত পরিমাণে ডলার কেনা হয়েছে।”
নিয়মিত ডলার কেনার প্রভাব
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক মোট ২২৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার কিনেছে। শুধু গত বৃহস্পতিবার পাঁচটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কিনেছে আরও ১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার—প্রতি ডলারে ১২২ টাকা ২৯ পয়সা দরে। একইদিন আন্তঃব্যাংকে ডলারের গড় দাম ছিল ১২২ টাকা ২৭ পয়সা।
এর আগে রোববার আরও ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার কেনা হয়। দুই মাসের ব্যবধানে ক্রয়মূল্য বেড়েছে প্রায় ৪৯ পয়সা। আমদানিকারকদের দাবি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই বাড়তি দামে কেনা বাজারের পুরো দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
রমজান সামনে রেখে এলসি খোলা বেড়েছে
নভেম্বর মাসে বিভিন্ন পণ্যের ৫৫৬ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে—যা এক মাসে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। একই মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৮৬ কোটি ৯৯ লাখ ডলার।
জুলাই–নভেম্বর পাঁচ মাসে মোট এলসি খোলা হয়েছে ২ হাজার ৯৪১ কোটি ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৪.৫৯ শতাংশ বেশি। তবে একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২.৬৬ শতাংশ।
সব মিলিয়ে, রমজানকে ঘিরে আমদানির চাপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনা—সবকিছু মিলিয়ে ডলারবাজারে নতুন ধরনের উত্তাপ তৈরি হয়েছে। আমদানিকারকদের উদ্বেগও তাই সহজে কাটছে না।

