সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটেনি। এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের অনেকেই মনে করেন যে বাড়তি সুদহার ও বিদ্যমান কর ব্যবস্থা এর জন্য দায়ী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটেনি। এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের অনেকেই মনে করেন যে বাড়তি সুদহার ও বিদ্যমান কর ব্যবস্থা এর জন্য দায়ী। বিগত সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফা নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, যার হার বর্তমানে ১০ শতাংশ। এতে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১৫-১৬ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিদ্যমান কর ব্যবস্থাও নানা জটিলতা তৈরি করেছে বলে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। আয়কর আইনের ১৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, অগ্রিম কর হিসেবে পরিশোধযোগ্য ন্যূনতম কর চারটি সমান কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়। এর মধ্যে অর্থবছরের ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৫ ডিসেম্বর, ১৫ মার্চ ও ১৫ জুন প্রতি কিস্তিতে অগ্রিম করের ২৫ শতাংশ করে পরিশোধ করা যায়। এছাড়া আইনে ৫৩ ধরনের উৎসে কর কর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা অগ্রিম কর হিসেবেই কাটা হয়। তবে উৎসে কর প্রধানত দুই ধরনের—একটা চূড়ান্ত, আরেকটি সমন্বয়যোগ্য। যেটা চূড়ান্ত কর সেটি আর ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। আর সমন্বয়যোগ্য করের ক্ষেত্রে পাওনা হলে ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে সমন্বয় প্রক্রিয়ায় বেশ জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।
অগ্রিম করের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হলো মুনাফার হার বিবেচনা ছাড়াই এ কর আহরণ করা হয়। যে কারণে কোনো কোনো কোম্পানিকে মুনাফার চেয়ে বেশি অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করে লোকসান গুনতে হয়। এসব কারণে অগ্রিম কর এখনো রাজস্ব আহরণের জন্য কার্যকর পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারেনি। এমনকি রাজস্ব ফাঁকি রোধ করতেও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেনি। উল্টো ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছু বিপত্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এতে অনেক সময় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে আনে।
তবে ব্যবসা সম্প্রসারণের পথে এগুলোই প্রধান প্রতিবন্ধকতা, সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। নীতি সুদহার দুই অংকের ঘরে উন্নীত হওয়ার ঘটনা অতি সাম্প্রতিক। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই দেশে ব্যবসার পরিবেশ স্বস্তিদায়ক নয়। এ দেশে ব্যবসার বিকাশে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ব্যবসা ব্যয়। এছাড়া রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সীমাহীন দুর্নীতি। নানা সময়ে বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত জ্বালানি ও অবকাঠামোগত সংকট। অথচ শিল্পায়নের জন্য, ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধিতে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এর বাইরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির হারও প্রভাব ফেলে ব্যবসার ব্যয়ের ওপর। আর মূল্যস্ফীতির পেছনে বড় দায় রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার। পণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের তদারকি প্রয়োজন, তা দেখা যায় না। যে কারণে প্রায় এক রাতের ব্যবধানে যেকোনো পণ্যের দাম কয়েক গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে দেখা যায়। বিশেষ করে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, সয়াবিন তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারদর অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আবার মূল্যস্ফীতির কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়লে সেটি পণ্যের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়, যা পক্ষান্তরে মূল্যস্ফীতিকেই উসকে দেয়। এটা চক্রাকারে একে অন্যকে প্রভাবিত করে। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। একই কারণে কঠোর মুদ্রানীতির প্রয়োগ করেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কারণ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে মুদ্রাপ্রবাহের চেয়ে বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাই বেশি দায়ী বলে বিগত কয়েক বছরে নানা আলোচনা, প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়া সমীচীন নয়। অর্থনীতির স্বার্থে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা জরুরি। পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতেও উদ্যোগ প্রয়োজন। তাই সরকারকে এমন পথে হাঁটতে হবে, যা নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে সুরক্ষা দেবে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পাবে। তাছাড়া বিষয় দুটি যেহেতু চক্রাকারে একে অন্যকে প্রভাবিত করে, তাই সরকারের উদ্যোগের মধ্যে অবশ্যই দুই বিষয়কেই সমগুরুত্ব দিতে হবে এবং সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে নীতি সুদহার কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটিও মাথায় রাখা প্রয়োজন যে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। একই সঙ্গে প্রয়োজন কার্যকর, শক্তিশালী ও যৌক্তিক বাজার ব্যবস্থাপনার। এ দেশে মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণগুলোর একটি হলো চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সংকট। এ সংকট বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি সময়মতো আমদানি বা আমদানি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেও হয়। উভয়ই বাজার অব্যবস্থাপনার নজির। এসব কারণে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা আবশ্যক। যত দ্রুত বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। সরকারকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ব্যবসা পরিস্থিতিও উন্নত হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আগামীতে নির্বাচন ঘিরে বাজারে নগদ অর্থের চাহিদা বাড়তে পারে। কিন্তু সেসময় এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি আবারো ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে যেতে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে। ব্যবসায়ীদেরও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেলে ব্যবসা করা আরো কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে তারাও ভেবে দেখতে পারেন যে উৎপাদন ব্যয় কোনোভাবে কমানো সম্ভব কিনা। তাতে মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে।
ব্যবসায়ীদের কীভাবে স্বস্তি দেয়া যায়, সেটিও সরকারকে চিন্তা করতে হবে। নীতি সুদহার যদি কমানো সম্ভব না হয়, অন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সেগুলো ভাবা প্রয়োজন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতি ধারাবাহিকতার অনিশ্চয়তাও ব্যবসা-বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণায় সে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নয়ন ঘটলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আসেনি। তবে আশা করা যায়, নির্বাচিত সরকার এলে অন্তত নীতি ধারাবাহিকতা নিয়ে অনিশ্চয়তা অনেকটাই কেটে যাবে।
এর বাইরে কর ব্যবস্থা নিয়েও চিন্তার অবকাশ রয়ে গেছে। সেটিকে ব্যবসাবান্ধব করে তুলতে হবে। সমন্বয়যোগ্য অগ্রিম কর নিয়ে যেসব জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে তা কমিয়ে আনতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। কেননা অগ্রিম কর ব্যবস্থাকে রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি দেয়ার নজিরও কম নয়। সর্বোপরি ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন। যেমন জ্বালানি নিরাপত্তা। টেকসই পদক্ষেপ ছাড়া ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটবে বলে প্রতীয়মান হয় না। সূত্র: বণিক বার্তা

