২০২৫ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুনরুদ্ধারের আশাব্যঞ্জক লক্ষণ দেখা গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্টেট অব দ্য ইকোনমি ২০২৫’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে গতকাল সোমবার (৮ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হলেও এখন প্রধান সূচকগুলো ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। জিইডি জানিয়েছে, ২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় কম হবে বলে বড় উন্নয়ন সহযোগীরা ধারণা করছে। বিশ্বব্যাংক ৩.৩ থেকে ৪.১ শতাংশ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৩.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। তবে ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৫.১ থেকে ৫.৩ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের বহিঃখাতের স্থিতিশীলতা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ, আমদানি স্থিতিশীলতা এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পুনরুদ্ধার অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সাহায্য করছে। রপ্তানি আয়ও দৃঢ় রয়েছে। তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা, নীতি মেনে চলা এবং বাজার বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম অবস্থায় আছে, যা বিচক্ষণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।
প্রতিবেদনটিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে দুই বিভাগে ভাগ করার প্রস্তাবের কারণে জুন মাসে রাজস্ব সংগ্রহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়ও উল্লেখ আছে। পরে কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর রাজস্ব আদায় স্বাভাবিক হয়েছে।
জিইডি বিশেষভাবে বলেছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং আর্থিক খাত স্থিতিশীল করা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য অপরিহার্য। যদিও পূর্বাভাসগুলো পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে, প্রবৃদ্ধি কতটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং জীবনমান উন্নয়নে রূপান্তরিত হবে তা কার্যকর নীতি, শক্তিশালী আর্থিক খাতের শাসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলের ওপর নির্ভর করবে।
প্রতিবেদনটিতে দুর্বল বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প কার্যক্রমকে প্রবৃদ্ধির বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিপরীতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি কার্যকারিতা এবং উৎপাদন খাতের আউটপুট—বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প—প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে এবং ২০২৬ অর্থবছরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে সীমিত রিজার্ভ, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট, ক্রেতাদের পরিবর্তিত পছন্দ, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা এবং ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যাচ্ছে।
জিইডি বলেছে, বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। বৃহৎ শ্রমবাজারের চাহিদা মোকাবিলা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি—বিশেষ করে পোশাক ও এসএমই খাতে—রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। মূল দুর্বলতাগুলো যেমন মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের অস্থিরতা, দুর্বল বিনিয়োগ পরিবেশ, সুশাসন সংকট এবং বৈদেশিক ঝুঁকি সমাধান করতে ব্যর্থ হলে প্রবৃদ্ধি মন্থর হতে পারে, জীবনমান খারাপ হতে পারে, দারিদ্র্য বাড়তে পারে এবং বৈষম্য দেখা দিতে পারে।
অন্যদিকে, সময়োপযোগী ও সমন্বিত নীতি সংস্কার, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং স্পষ্ট নীতিগত বার্তা প্রদান নিশ্চিত করলে বাংলাদেশ পুনরায় গতি ফিরে পাবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।
জিইডি উপসংহারে বলেছে, কাঠামোগত সংস্কার এবং উদ্ভাবন-নির্ভর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সমর্থিত একটি সুপরিকল্পিত জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশল ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনাকে পরিচালিত করবে, যা স্থিতিস্থাপকতা ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াবে।

