জ্বালানি ও বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতের ১৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এই কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি বড় অংশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখে, যা দীর্ঘমেয়াদি ও চলতি হিসাবের আকারে রাখা হয়। চলতি বছরের জুন মাসের শেষ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০,৫৬৭ কোটি টাকা, যার একটি বড় অংশই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের।
তবে কিছু অংশ দুর্বল ব্যাংকে থাকা কারণে সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন যে, এসব আমানত কি পুরোপুরি ফেরত পাওয়া যাবে কি না।
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের অবস্থান
তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জমা রয়েছে মেঘনা পেট্রোলিয়ামে, যা প্রায় ৬,৬১০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে এর আমানত বিতরণ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আইএফআইসি ব্যাংকে ৪৪৩ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকে ৪৩২ কোটি, জনতা ব্যাংকে ৪০৩ কোটি, সিটি ব্যাংকে ৩৯৫ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকে ৩৭৭ কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি ব্যাংকে লক্ষাধিক কোটি টাকা জমা আছে।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মহাব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) সঞ্জীব নন্দী জানিয়েছেন, “আমরা এই আমানতের অর্থ আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রশাসকদের সঙ্গে চিঠিপত্র ও আলোচনা চালাচ্ছি। আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে। তবে অনেক ব্যাংকে শুধু আমাদের নয়, অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও অর্থ রয়েছে, তাই সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছি।”
অন্যান্য বড় কোম্পানির ব্যাংক আমানত
-
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন
জুন শেষে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক আমানত ৬,২৯৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে সরকারি ব্যাংকে ৩,৪২৬ কোটি এবং বেসরকারিতে ৫৩১ কোটি টাকা এফডিআর রয়েছে। নগদ আকারে আরও ২,৩৪১ কোটি টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে। -
যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড
এ প্রতিষ্ঠানের আমানত ৫,৬০৮ কোটি টাকা, যা ৩০টির বেশি ব্যাংকে বিতরণ করা হয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৭২০ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫২২ কোটি, সিটি ব্যাংকে ৪৯০ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকে ৪৪২ কোটি এবং অন্যান্য ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রয়েছে। -
পদ্মা অয়েল পিএলসি
পদ্মা অয়েল ব্যাংকে রাখেছে মোট ৫,৫০৪ কোটি টাকা, যেখানে জনতা ব্যাংকে ৯২৫ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৭০৩ কোটি, এবি ব্যাংকে ৬৪১ কোটি এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫৭৪ কোটি টাকা রয়েছে।
পদ্মা অয়েলের মহাব্যবস্থাপক কাঞ্চন চন্দ্র সোম বণিক বলেন, “আমাদের অধিকাংশ আমানত নিরাপদ ব্যাংকে রয়েছে এবং নিয়মিত সুদও পাচ্ছি। দুর্বল ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।” -
ডিএসকো ও পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ
ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই (ডিএসকো) জুনে ব্যাংকে রাখেছে ১,৮৭৯ কোটি টাকা, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি আমানত ৮০৭ কোটি, স্বল্পমেয়াদি ৩০ কোটি এবং নগদ ১,৪২ কোটি টাকা।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখেছে ১,৭৫৫ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৮৯৯ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংকে ৩৭০ কোটি টাকা সবচেয়ে বড় অংশ। -
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে মোট ১,৩০৬ কোটি টাকা জমা, যেখানে জনতা ব্যাংকে ৩৯৪ কোটি, বেসিক ব্যাংকে ৩৮১ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকে ৩৭৪ কোটি। -
ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)
আইসিবি এনবিএফআইতে রাখেছে মোট ১,০৮২ কোটি টাকা। এ অর্থের বেশ কিছু অংশ দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোতে আটকে রয়েছে। চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বণিক বলেন, “কিছু এনবিএফআইতে আমাদের টাকা আটকে আছে। আমরা অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম দেখছি।” -
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস পিএলসি
ব্যাংকে মোট ৪৪৭ কোটি টাকা আমানত রয়েছে, যা ২০টির বেশি ব্যাংকে বিতরণ করা হয়েছে।
দুর্বল ব্যাংক ও একীভূতকরণ
সরকার ইতোমধ্যেই একীভূতকরণের মাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংককে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তর করেছে। এই পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসক ও সহকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “একীভূতকরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। সরকারের ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছে, বাকি ১৫ হাজার কোটি বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এই প্রক্রিয়ার ফলে আমানতকেও মূলধন হিসেবে রূপান্তর করা হতে পারে।”
একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ৯টি এনবিএফআইকে অবসায়নে অনুমোদন দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির আমানত রয়েছে।
সর্বোপরি, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা ও নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন, যাতে আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এবং দুর্বল ব্যাংক থেকে অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়।

