বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ঋণের উচ্চ সুদ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, রফতানি হ্রাস, বাজারে কম চাহিদা এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা—সব মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ বাড়ছে। শেয়ার বাজারে লেনদেন কমে গেছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, এবং বৈদেশিক ঋণের বোঝাও আগের চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে অন্তত ৯টি বড় চ্যালেঞ্জকে স্পষ্ট করেছে।
রফতানিতে চার মাসের পতন
সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, পণ্য রফতানি টানা চার মাস ধরে নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। নভেম্বর মাসে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ২৩ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। মাসটি শেষ হয়েছে ৩৮৯ কোটি ডলারে, যা গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
যুক্তরাষ্ট্র ৭ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এর আগে শুল্ক এড়াতে আগাম আমদানির ফলে জুলাইয়ে রফতানি ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আগস্টে কমে ৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরেও ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
পণ্যভিত্তিক হ্রাস
-
তৈরি পোশাক: ৫ শতাংশ কম, রফতানি ৩১৪ কোটি ডলার (গত বছরের ৩৩১ কোটি)
-
কৃষিপণ্য: ২৫ শতাংশ কম, ৮৩ মিলিয়ন ডলার
-
ওষুধ: ৯ শতাংশ কম, ২০ মিলিয়ন ডলার
-
হোম টেক্সটাইল: ৮ শতাংশ কম, ৬৬ মিলিয়ন ডলার
-
পাট ও পাটজাত পণ্য: ১০ শতাংশ কম, ৬৯ মিলিয়ন ডলার
-
চামড়া: ২২ শতাংশ কম, তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মোট রফতানি বেড়ে ৫ শতাংশ
-
হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ: ৯ শতাংশের বেশি কম
বিজিএমইএ পরিচালক এবিএম শামসুদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, ইইউ বাজারে চীনের আগ্রাসী রফতানি বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা কমাচ্ছে। এছাড়া তৈরি পোশাকের লিন সিজন—জানুয়ারি পর্যন্ত চলা—ও রফতানি আয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলছেন, “নতুন বাজার, নতুন পণ্য এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ছাড়া আগামীর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন।”
ব্যবসায়ের ওপর অতিরিক্ত কর চাপ
উচ্চ সুদ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলার অস্থিতিশীলতা—সব মিলিয়ে ব্যবসা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বিনিয়োগ অতীতের তুলনায় সবচেয়ে কম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির মুখে। তবে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার শর্ত পূরণের জন্য এনবিআর লক্ষ্য আরও ৫৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সংকটাপন্ন পরিবেশে করের অতিরিক্ত চাপ নতুন করে উদ্বেগের কারণ।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদের পরিবেশে ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে কর চাপ বাড়ানো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।”
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “আমরা লাভ করি বা লোকসান করি—সব অবস্থাতেই কর দিতে হচ্ছে। এমন অযৌক্তিক চাপ থেকে মুক্তি চাই।”
বিডা চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “বিভিন্ন দফতরে ঘুরতে গিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারি সেবাগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আনা হচ্ছে।”
শেয়ার বাজারে আস্থা নেই
বাজারে ঘন ঘন দরপতন, লেনদেনের খরা, বিনিয়োগকারীর আস্থাহীনতা—এগুলো বাজারের প্রধান চিত্র। আগের অনিয়ম ও দোষীদের শাস্তি না হওয়ায় আস্থা ফিরে আসছে না। রবিবার ডিএসইতে লেনদেন মাত্র ২৬৭ কোটি টাকার ঘরে নেমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিশ্চয়তা দূর না হলে বাজারে আস্থা ফেরানো কঠিন। বিনিয়োগকারীরা আরও বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে।
অর্থনীতির ধীরগতি
নভেম্বর মাসের পিএমআই রিপোর্টে দেখা যায়, অর্থনীতির সম্প্রসারণ ধীর হয়েছে। সূচক ৬১.৮ থেকে কমে ৫৪ পয়েন্টে নেমেছে। উৎপাদন, নির্মাণ, সেবা ও কৃষি খাত—সবখাতেই সম্প্রসারণের গতি কমেছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “বৈশ্বিক চাহিদা কমা, রফতানি প্রতিযোগিতার চাপ, অভ্যন্তরীণ বাজারে দুর্বল চাহিদা এবং নির্বাচনী অনিশ্চয়তা—এসবই অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করছে।”
মূল্যস্ফীতি আবারও বেড়েছে
নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮.২৯ শতাংশে পৌঁছেছে, আগের মাসে যা ছিল ৮.১৭ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭.৩৬ শতাংশ, শহর-গ্রামে উভয় অঞ্চলে ঊর্ধ্বমুখী।
তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় আছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাসওয়ারি চিত্র ওঠানামার মধ্যে রয়েছে।
ঋণের চাপ দ্বিগুণ
গত পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ ৪২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০ সালে সুদ ও মূলধন পরিশোধ ছিল ৩৭৩ কোটি ডলার, ২০২৪ সালে বেড়ে ৭৩৫ কোটি ডলার। রফতানির তুলনায় ঋণ ১৯২ শতাংশ, ঋণ পরিষেবা রফতানির ১৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, ঋণ পরিশোধের চাপ দ্রুত বাড়ছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
বিদেশি ঋণের প্রধান উৎস: বিশ্বব্যাংকের আইডিএ (২৬%), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপান।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট—রফতানি হ্রাস, ঋণের চাপ, উচ্চ সুদ, মূল্যস্ফীতি ও করের অতিরিক্ত বোঝা দেশের অর্থনীতিকে সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। বিনিয়োগ স্থগিত ও শেয়ার বাজারে আস্থাহীনতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে জটিল করছে।

