দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পথে। বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে কাজ করা ১৯টি বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) বা অফ-ডক রপ্তানি পণ্য লোড এবং খালি কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে।
ডিপো মালিকরা জানিয়েছেন, বর্তমান মাশুল বা চার্জে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। দীর্ঘ নয় বছর ধরে ট্যারিফ অপরিবর্তিত থাকায়, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির চাপ ও অন্যান্য খরচ সামলানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু মাশুল বাড়ানোর অনুমতি এখনও মেলেনি। ফলে মালিকদের জন্য কার্যক্রম বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইলো না।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, “সংগঠনের কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেই, তবে ব্যক্তিগতভাবে মালিকরা গ্রাহকদের জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা সেবা দিতে পারবে না। শিপিং লাইনগুলোও বিষয়টি জানানো হয়েছে। সর্বশেষ ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছিল ২০১৬ সালে, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি এবং অন্যান্য খরচ সামলানো এখন প্রায় অসম্ভব।”
বন্ধ হলে সম্ভাব্য প্রভাব
যদি ডিপোগুলো কার্যক্রম বন্ধ করে, তবে অফ-ডকের মাধ্যমে সব ধরনের রপ্তানি চালান এবং খালি কনটেইনার পরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে। এতে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো সরাসরি প্রভাবিত হবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।
১৯টি আইসিডি দেশের রপ্তানির একটি অপরিহার্য অংশ। এরা সব ধরনের রপ্তানি পণ্য, অধিকাংশ খালি কনটেইনার এবং ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে। মালিকদের বক্তব্য, “অফ-ডক কার্যক্রম বন্ধ হলে বন্দরের কার্যক্রমে ধস নামবে এবং দেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।”
এই ১৯টি ডিপোর মোট ধারণক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার টিইইউএস, যা বন্দরের নিজস্ব ইয়ার্ডের ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। বছরে তারা প্রায় ২২ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে।
ট্যারিফ বৃদ্ধি: ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ
সমস্যার মূল সূত্রপাত হচ্ছে ট্যারিফ বাড়ানোর উদ্যোগ থেকে। আগস্টে বিকডা শ্রমিকদের বেতন, গ্রাউন্ড রেন্ট, লিফট-অন/লিফট-অফ চার্জ এবং ডকুমেন্টেশন ফি ৩০–৬৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তবে বন্দরের ব্যবহারকারীরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন।
মধ্যস্থতার কয়েক দফা ব্যর্থ হওয়ায় বিষয়টি আদালতে গড়ায় এবং আদালত বর্ধিত ট্যারিফ স্থগিতের নির্দেশ দেন। পরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় জানায়, ট্যারিফ কমিটির অনুমোদন ছাড়া কোনো নতুন চার্জ আরোপ করা যাবে না। এর ফলে মালিকরা পুরোনো হারে কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
তিন মাস পর মালিকরা এখন ভিন্ন কৌশল বেছে নিয়েছেন। কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই প্রধান শিপিং লাইনগুলোকে মৌখিকভাবে কনটেইনার না পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও বন্দর ব্যবস্থাপনা
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বিষয়টি তারা শুনেছেন, তবে বিকডা থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি পাননি। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন সতর্ক করে বলেন, “এ ধরনের অঘোষিত সিদ্ধান্ত দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করছে। একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বন্দর কার্যক্রমে সমস্যা ঘটলে তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এত বড় পদক্ষেপ নেওয়ার আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি।”
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ অবস্থা তৈরি হলে রপ্তানি বন্ধ এবং খালি কনটেইনার বন্দরে আটকে যাবে, যা দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক।

