রেকর্ড সংখ্যক মানুষ বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন—সংখ্যার বিচারে এটি নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। কিন্তু পরিসংখ্যানের আড়ালে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বাস্তবতা খুব একটা বদলায়নি। বরং একই ঝুঁকি, একই অনিশ্চয়তা আর একই দুর্বল ব্যবস্থার ভেতর দিয়েই চলছে শ্রম রপ্তানির পুরোনো চক্র।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা ১০ লাখ ৭১ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ৭ লাখের বেশি শ্রমিক—অর্থাৎ মোটের অর্ধেকেরও বেশি।
এই একমুখী নির্ভরতাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সৌদি আরবের নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এলেই বাংলাদেশের শ্রম রপ্তানি ব্যবস্থা বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে—এমন আশঙ্কা এখন আর তাত্ত্বিক নয়, বাস্তব।
মহামারির পর ২০২২ সালে নারী অভিবাসনের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু সেই ধারা টেকেনি। ২০২৪ সালে নারী কর্মীর সংখ্যা নেমে আসে ৬০ হাজারের ঘরে। আর ২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসে বিদেশে গেছেন মাত্র ৫৬ হাজারের কিছু বেশি নারী—২০২২ সালের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
নারী শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ, দক্ষ ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের কোনো স্পষ্ট রূপরেখা এখনো দেখা যাচ্ছে না। ফলে সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
প্রবাসীরা প্রতিবছর দেশে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। অথচ সেই মানুষগুলোর কল্যাণে বরাদ্দ কমছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট এক হাজার ২০০ কোটির বেশি থেকে নেমে এসেছে ৮৫৫ কোটিতে। গত পাঁচ বছরে জাতীয় বাজেটে এই খাতের অংশ গড়ে দশমিক শূন্য ৮ শতাংশের বেশি হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি স্পষ্ট করে দেয়—নীতিনির্ধারণে প্রবাসী শ্রমিকেরা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন না। প্রবাসী লাউঞ্জ, পোস্টাল ব্যালটে ভোট কিংবা কিছু দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থাকলেও এগুলো কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে পারেনি।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বিদেশে যাওয়ার সবচেয়ে বড় বাধা এখনো অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়। একই দেশে যেতে নেপালি শ্রমিকদের তুলনায় বাংলাদেশিদের তিন থেকে চার গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়। এর পেছনে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত দালালচক্র ও দুর্বল তদারকি।
সরকার ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ঠিক করলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। অতিরিক্ত টাকা নেওয়া সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় পুরো ব্যবস্থার বোঝা গিয়ে পড়ে শ্রমিকের ঘাড়ে।
ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ডে মাথাপিছু ৩ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হলেও সেই অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক খাতে—বিপদে পড়া শ্রমিকদের সহায়তায় নয়।
বাংলাদেশ এখনো মূলত কম দক্ষ শ্রমিক পাঠাচ্ছে কম মজুরির বাজারে। বিএমইটির প্রশিক্ষণগুলো স্বল্পমেয়াদি, আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বলভাবে স্বীকৃত এবং বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে অনেক সময়ই অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে দক্ষ শ্রম অভিবাসনের একটি সুস্পষ্ট পথ তৈরি হয়নি। নার্সিং বা কারিগরি পেশায় বড় সুযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ডিগ্রির অভাবে সেই দরজা খোলা যাচ্ছে না।
মালয়েশিয়া, উপসাগরীয় দেশ কিংবা ইউরোপ—সব জায়গা থেকেই দূতাবাস সেবার ব্যর্থতার অভিযোগ আসছে। শ্রম উইংগুলো জনবলস্বল্প, ধীরগতির এবং অনেক সময় শ্রমিকদের নাগালের বাইরে।
বিদেশে সমস্যায় পড়লে অনেক শ্রমিক দূতাবাসে গিয়ে দিকনির্দেশনা পান না। ফোন ধরা হয় না, অ্যাপয়েন্টমেন্টের নামে ঘোরানো হয়। ফলে বাধ্য হয়ে তারা আবার দালালের দ্বারস্থ হন—যা পুরো ব্যবস্থাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
মালয়েশিয়া, ওমান বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার এখনো পুরোপুরি খোলা যায়নি। আগের বন্ধ হয়ে যাওয়া বাজারগুলোরও পুনরুজ্জীবন হয়নি। এমনকি সৌদি আরবেও নতুন কড়াকড়ি—ইকামা জটিলতা, বেতন বিলম্ব, চাকরি বদলের বাধা—শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী বছর হঠাৎ করেই বিদেশে কর্মী পাঠানোর হার কমে যেতে পারে।
আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস। কিন্তু অনেক শ্রমিকের কাছে এসব দিবসের উদযাপন ফাঁপা মনে হয়।
একজন প্রবাসী শ্রমিকের কথায়, “আমরাই দেশে ডলার পাঠাই। কিন্তু বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এখনো রেমিট্যান্সকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, শ্রমিককে নয়। যত দিন এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না, তত দিন সংখ্যার সাফল্য বাস্তব নিরাপত্তায় রূপ নেবে না।

