বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনহীনতা এবং অর্থনৈতিক মন্দার যে ত্রিমুখী সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, তা সাধারণ কোনো ব্যবসায়িক মন্দা নয় বরং ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। এই চরম অনিশ্চয়তার সময়ে একজন দূরদর্শী ব্যবসায়ীর জন্য লাভ বা ‘প্রফিট’ মার্জিনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় নগদ অর্থের সরবরাহ বা ‘ক্যাশ ফ্লো’ সচল রাখা। যখন একটি দেশের উৎপাদনশীলতা নিম্নমুখী হয় এবং বাজারে লেনদেন স্থবির হয়ে পড়ে, তখন গতানুগতিক ব্যবসার মডেল ভেঙে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে তারল্য বা লিকুইডিটি বজায় রাখাই হলো টিকে থাকার একমাত্র চাবিকাঠি।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, এডমন্ড বার্ক যে সম্পদ নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন, তা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসায়ীর জন্য ধ্রুব সত্য। যদি ব্যবসার সম্পদ বা ইনভেন্টরি আপনার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেই সম্পদই আপনাকে দেউলিয়া করার জন্য যথেষ্ট। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুদামে পণ্য মজুত না রেখে সামান্য লাভে বা প্রয়োজনে ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে বিক্রি করে হাতে নগদ টাকা নিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১০% ছাড়িয়ে যাওয়া মানে হলো, আপনার হাতে থাকা অলস টাকার ক্রয়ক্ষমতা প্রতিদিন কমছে। তাই টাকাকে পণ্য বা কাঁচামালে রূপান্তর করার সময় তার ঘূর্ণন গতি (ভেলোসিটি) বজায় রাখা অপরিহার্য।
বাংলাদেশের বর্তমান শ্রমবাজার ও উৎপাদনশীলতার চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা কর্মসংস্থানের সুযোগকে সংকুচিত করে ফেলেছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াই স্বাভাবিক। এই স্থবিরতার সময়ে একজন পেশাদার ব্যবসায়ীকে কঠোর মিতব্যয়িতা বা ‘অস্টারিটি’ নীতি অবলম্বন করতে হয়। এর অংশ হিসেবে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অদক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই করে দক্ষ ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কর্মী বাহিনীকে গুরুত্ব দিতে হয়। পূর্ণকালীন কর্মী নিয়োগের বিকল্প হিসেবে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেওয়া বর্তমান বিশ্বের একটি স্বীকৃত সংকটকালীন কৌশল।
বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন সমীক্ষা বারবার প্রমাণ করেছে, মন্দার সময় যে কোম্পানিগুলো তাদের ‘অ্যাকাউন্টস রিসিভেবল’ বা দেনাদারদের কাছ থেকে দ্রুত টাকা আদায় করতে পারে, তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা সাধারণ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কয়েক গুণ। বর্তমান বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী এবং তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে কঠোরতা অবলম্বন করছে। এমতাবস্থায় উচ্চ সুদে ব্যাংক লোন নেওয়া হবে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেওয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ব্যবসায়ীদের এখন উচিত ব্যাংক-নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব মূলধন এবং আগের সঞ্চিত মুনাফা বা রিটেইন্ড আর্নিংসের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা পরিচালনা করা। সুদের চক্রবৃদ্ধি হারের যে বোঝা, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে বড় বিনিয়োগ পিছিয়ে দেওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদি বাকিতে কাঁচামাল পাওয়ার ক্ষমতা এই মুহূর্তে যে কোনো ব্যাংক লোনের চেয়েও বেশি কার্যকর।
ব্যবসায়িক বৈচিত্র্যকরণ বা ডাইভারসিফিকেশন এখন আর বিলাসিতা নয়। বরং টিকে থাকার আবশ্যিক কৌশল। যদি কোনো ব্যবসা শুধু একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা স্থানীয় বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তবে অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই ব্যবসার অপমৃত্যু অনিবার্য। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র পণ্য বা ডিজিটাল সেবা প্রদানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ প্রশস্ত করা যেতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির এই সময়ে টাকা বা টাকার মানের ক্রমাগত অবমূল্যায়ন থেকে বাঁচতে ডলার বা শক্তিশালী মুদ্রায় আয় করা একটি বড় নিরাপত্তা ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারে।
জোসেফ শুমপিটারের সেই ‘সৃজনশীল ধ্বংস’ বা ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি সংকটই পুরোনো ও অকেজো ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নতুনের পথ তৈরি করে। যারা প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে উদ্ভাবনী চিন্তা করবে এবং ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে ঘরে বসেই বৈশ্বিক ক্লায়েন্টদের সেবা দেবে, তারাই এই মন্দার শেষে বিজয়ী হয়ে ফিরবে। এই পরিবর্তনের যুগে ডেটা-চালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। আপনার ব্যবসার কোন পণ্যটি সবচেয়ে দ্রুত নগদে রূপান্তরযোগ্য এবং কোনটি লোকসান দিচ্ছে, তা নির্ণয় করতে নিয়মিত ফিন্যান্সিয়াল অডিট করা প্রয়োজন।
সবশেষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিরাপত্তা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। আইনহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতার এই সময়ে ব্যবসায়িক স্থাপনা, গুদাম বা কলকারখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের শিকার হতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে ‘পলিটিক্যাল রিস্ক ইন্স্যুরেন্স’ একটি সাধারণ বিষয় হলেও আমাদের দেশে এর ব্যবহার খুবই সীমিত। বড় ও মাঝারি অবকাঠামোগত ব্যবসার ক্ষেত্রে এ ধরনের বীমা গ্রহণ করা এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল সিকিউরিটির দিকেও নজর দিতে হবে। কারণ অস্থিরতার সুযোগে সাইবার অপরাধও বৃদ্ধি পায়।
দিনশেষে সংকট যত দীর্ঘ হবে, রবার্ট কিয়োসাকির সেই বাণী তত বেশি বাস্তব মনে হবে– সংকটে এক দল হারবে এবং অন্য দল যারা প্রস্তুত থাকবে তারা জয়ী হবে। বর্তমান এই প্রতিকূল সময়ে সফল ব্যবসায়ী হওয়ার চেয়ে একজন ‘সারভাইভার’ হওয়া বেশি জরুরি। যখন সমুদ্র উত্তাল থাকে, তখন পাল তোলার চেয়ে নোঙর শক্ত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিই হবে একজন ব্যবসায়ীর মূল হাতিয়ার। অস্থিরতা যখন তুঙ্গে, তখন আবেগি সিদ্ধান্ত না নিয়ে গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিটি পদক্ষেপই হবে বিচক্ষণতা। এই কঠিন সময় পার করতে প্রয়োজন সীমাহীন ধৈর্য এবং নিখুঁত ক্যাশ ফ্লো ট্র্যাকিং, যা নিশ্চিত করবে যে আপনার ব্যবসার লাইফলাইন বা রক্ত সঞ্চালন যেন কোনোভাবেই বন্ধ না হয়। যারা আজ টিকে থাকবে, তারাই আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে।
লেখক:সাইফুল হোসেন: ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট, সূত্র:সমকাল

