গত তিন দশকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রযাত্রা। একসময় দেশের উচ্চশিক্ষার মূল ভরসা ছিল অল্পসংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আসন সংকট, সেশনজট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বহু শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। এ পরিস্থিতিতে নব্বইয়ের দশকে উচ্চশিক্ষায় বৈপ্লবিক সমাধান হিসেবে যাত্রা শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের বড় অংশের মতে, নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা, স্থিতিশীল পরিবেশ, সেশনজটের অভাব, সময়োপযোগী বিষয় এবং যোগ্য শিক্ষকের সহজপ্রাপ্যতা—এসবই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁদের আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী নাসরীন আক্তার জানান, যদিও তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, পছন্দসই বিষয়ে না পাওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই তাঁর কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা তাঁর শিক্ষাজীবনকে সহজ করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষার্থী তানজিলা আহমেদ বলেন, ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়নের সুযোগ পাবলিকে সীমিত ছিল বলেই তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট জাকিয়া ইসলাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। তিনি জানান, পরিবারে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেশনজট নিয়ে উদ্বেগ থাকায় ছোটবেলা থেকেই নর্থ সাউথ, ব্র্যাক কিংবা ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর। তাঁর অভিজ্ঞতাই তাঁকে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৫০তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে দেশের অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৪টি। এর মধ্যে ১০৫টিতে পাঠদান চলছে। বাকি ৯টির মধ্যে ৫টিতে পাঠদানের অনুমতি নেই এবং ৪টিতে জটিলতার কারণে পাঠদান স্থগিত রয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৪ জনে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৭ হাজার ৩১৬ বেশি। প্রতিবছরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ছে।
বিভাগভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে ভর্তি শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যও চোখে পড়ে—কৃষিতে ২ হাজার ৯২ জন, কলা ও মানবিকে ৩৯ হাজার ২১৫, জীববিজ্ঞানে ৫ হাজার ৭৫৪, ব্যবসায় শিক্ষায় ৮০ হাজার ৮৫৭, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৯, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জনস্বাস্থ্যে ৬ হাজার ৪০৫, আইন বিভাগে ২৩ হাজার ৬০৯, মেডিসিনে ১৩১, ফার্মেসিতে ১১ হাজার ৯৮১, বিজ্ঞানে ৭ হাজার ৬৫০, সামাজিক বিজ্ঞানে ১২ হাজার ৩৮৮, টেক্সটাইল ও ফ্যাশনে ১০ হাজার ৩৫৭, ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সে ৪০৭ এবং অন্যান্য বিষয়ে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৮৪৯ জন।
শিক্ষকের সংখ্যাতেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৩ সালে মোট শিক্ষক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৭৯ জনে—এর মধ্যে পূর্ণকালীন ১৩ হাজার ১৬৯ এবং খণ্ডকালীন ৪ হাজার ৩১০ জন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১:২১। একই বছরে পিএইচডিধারী শিক্ষক ছিলেন ৩ হাজার ৬০৩ জন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তিশালী অগ্রগতির অন্যতম বড় ধাপ হলো স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ। বর্তমানে ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আধুনিক অবকাঠামো, উন্নত ল্যাব, নিরাপদ পরিবেশ এবং গবেষণার সুযোগ শিক্ষার্থীদের আস্থা বৃদ্ধি করেছে।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, আইন, সামাজিক বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে আধুনিক প্রোগ্রাম চালু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাকরিবাজারে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বিদেশি শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও ক্রমবর্ধমান—৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮২৬ জন শিক্ষার্থী বিদেশ থেকে এসে পড়াশোনা করছেন।
সব মিলিয়ে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে আর বিকল্প নয়; বরং দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

