জাপানের রাজধানী টোকিওতে আগামী ২৭ অক্টোবর শুরু হতে যাচ্ছে ১০ দিনব্যাপী ৩৮তম টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (টিফ)। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত টোকিওর হিবিয়া, ইউরাকুচো, মারুনোউচি ও গিনজা এলাকায় চলবে এই উৎসব। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি থাকবে নানা কর্মশালা, সেমিনার ও প্রদর্শনী, যা টোকিওকে পরিণত করবে বিশ্ব চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মিলনস্থলে।
আয়োজকেরা জানিয়েছেন, এবারের আসর হবে চলচ্চিত্র, সংস্কৃতি ও ভাববিনিময়ের এক অনন্য মিলনমেলা। ১ অক্টোবর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উৎসবের বিস্তারিত জানানো হয়।
টিফের চেয়ারম্যান আন্দো হিরোইয়াসু জানিয়েছেন, এ বছরের তিনটি মূল লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক বিনিময় জোরদার করা, নারীর ক্ষমতায়ন উৎসাহিত করা এবং তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিকাশে সহায়তা করা।
তাঁর ভাষায়, “বিশ্বজুড়ে বিভাজন ও দ্বন্দ্বের সময়েও চলচ্চিত্র একতার সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে পারে।” এ ভাবনাকেই প্রতিফলিত করেছে এবারের পোস্টার, যেখানে দুই নারীকে একটি ক্যাফেতে প্রেম, যুদ্ধ ও রাজনীতি নিয়ে কথোপকথনে দেখা যাচ্ছে—যা পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্প্রীতির প্রতীক।
উৎসবের উদ্বোধনী ছবি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে জাপানি নির্মাতা সাকামোতো জুনজির ক্লাইম্বিং ফর লাইফ, যা এভারেস্ট জয়ী প্রথম নারী পর্বতারোহী তাবেই জুনকোর জীবনের ওপর নির্মিত। সমাপনী ছবি হিসেবে থাকবে অস্কারজয়ী পরিচালক ক্লোয়ে ঝাওয়ের হ্যামনেট, শেকসপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের অনুপ্রেরণায় নির্মিত এক প্রেম ও বিচ্ছেদের গল্প। ‘সেন্টার পিস’ হিসেবে প্রদর্শিত হবে ইয়ামাদা ইয়োজির টোকিও ট্যাক্সি, যেখানে আধুনিক মহানগর টোকিওর জীবনের টানাপোড়েন উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে জুরি বোর্ডের নেতৃত্ব দেবেন ইতালির চলচ্চিত্র সমালোচক কার্লো চ্যাট্রিয়ান। সহ-জুরি হিসেবে থাকছেন তাইওয়ানের অভিনেত্রী গিওয়েই লুন-মেই, ফরাসি সম্পাদক ম্যাথিউ ল্যাক্লাউ, জাপানি অভিনেতা ও নির্মাতা সাইতোহ তাকুমি এবং চীনা প্রযোজক ভিভিয়ান কু।

উৎসবের প্রোগ্রামিং ডিরেক্টর ইচিয়ামা শোজোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১০৮টি দেশ ও অঞ্চল থেকে জমা পড়া ১ হাজার ৯৭০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৫টি নির্বাচিত হয়েছে প্রতিযোগিতার জন্য।
তালিকায় আছে মেসিডোনীয় নির্মাতা তিওনা স্ট্রুগার মিতেভসকার মাদার, কম্বোডীয় রিথি পানের প্রামাণ্যচিত্র উই আর দ্য ফ্রুটস অব দ্য ফরেস্ট, চীনা ঝাং লুর মাদারটাং, আজারবাইজানের হিলাল বাইদারোভের সারমন টু দ্য ভয়েড এবং জাপানি সাকাশিতা ইউইচিরোর ব্লন্ড। রাজনীতিনির্ভর চলচ্চিত্রের মধ্য রয়েছে হ্যালি গেইটসের ইরাক যুদ্ধনির্ভর ব্যঙ্গাত্মক ছবি এট্রোপিয়া এবং ফিলিস্তিনি নির্মাতা এনেমারি জাকির প্যালেস্টাইন ৩৬, যেখানে ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
প্রোগ্রামিং ডিরেক্টর শোজো বলেন, “আমি চলচ্চিত্রের শিল্পমান ও বার্তাকে প্রাধান্য দিয়েছি। রাজনীতি বাস্তবতার অংশ, তাই চলচ্চিত্রেও তার প্রতিফলন অনিবার্য।”
তরুণ নির্মাতাদের উৎসাহ দিতে উৎসবে থাকছে এশিয়ান ফিউচার বিভাগ। প্রোগ্রামার ইশিজাকা কেনজির মতে, জাপান, কোরিয়া, তুরস্ক, চীন, সিঙ্গাপুর ও ইরানের ১০টি চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে এ বিভাগে। তবে এবার বাংলাদেশ ও ভারতের কোনো চলচ্চিত্র জায়গা পায়নি। উদ্বোধনী ছবি হবে জার্নি ইনটু সাতো তাদাও, যা প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক সাতো তাদাওকে ঘিরে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। জুরি বোর্ডের নেতৃত্ব দেবেন বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কর্মকর্তা এলেন ওয়াই ডি কিম।
নারী নির্মাতাদের জন্য থাকছে উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় আসর, যেখানে সাতটি নারীপ্রধান চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। অ্যানিমেশন বিভাগে থাকছে ১২টি নতুন জাপানি ও আন্তর্জাতিক ছবি। গালা বিভাগে ১৩টি প্রশংসিত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে, যার মধ্যে অ্যারি অ্যাস্টারের এডিংটন ও অলিভার ল্যাক্সের সিরাত অন্যতম।
চলচ্চিত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকেও নজর থাকবে উৎসবে। হামামাতসুচো-কান ভবনে অনুষ্ঠিত হবে ২২তম টিফকম, যেখানে চলচ্চিত্র, টিভি, অ্যানিমেশন ও স্ট্রিমিং সিরিজ নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা ও পিচ সেশন। ‘টোকিও গ্যাপ ফিন্যান্সিং মার্কেট’-এর মাধ্যমে ২৩টি প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে।
এবার কুরোসাওয়া আকিরা পুরস্কার পাচ্ছেন কোরীয় বংশোদ্ভূত জাপানি পরিচালক লি সাং-ইল ও চীনা পরিচালক ক্লোয়ে ঝাও। উৎসবে উপস্থিত থাকবেন জুলিয়েট বিনোশ, রিথি পান, অলিভার ল্যাক্স ও কোরে-এদা হিরোকাজু প্রমুখ আন্তর্জাতিক তারকা।
এবারের ফেস্টিভ্যাল ন্যাভিগেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জাপানি অভিনেত্রী তাকিউচি কুমি। তিনি দর্শকদের চলচ্চিত্র উপভোগে উৎসাহিত করবেন। তাকিউচি জানিয়েছেন, তিনি বিশেষভাবে অপেক্ষা করছেন ফিলিস্তিনের সংগ্রামনির্ভর প্যালেস্টাইন ৩৬ চলচ্চিত্রটির জন্য।
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা চলমান সমস্যার উৎস জানতে চাই। জাপানে শিল্পীরা রাজনীতি নিয়ে কথা বললে সমালোচনার মুখে পড়েন, অথচ এমন চলচ্চিত্রগুলো প্রেক্ষাগৃহে দেখা প্রায় অসম্ভব। তাই আমাদের চলচ্চিত্র উৎসবেই এগুলো দেখার অনন্য সুযোগ থাকে। আমি এটি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।”
সূত্র: টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ, জাপান টাইমস, রয়টার্স, ভ্যারিটি।