বিশ্ব বাঘ দিবস (২৯ জুলাই) উপলক্ষে বাংলাদেশে বাঘের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রূপে চিহ্নিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য “মানুষ-বাঘের সুরেলা সহাবস্থান” হলেও দেশে বাঘের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যার জন্য মূলত চোরাশিকারি ও আবাসস্থলের সংকটকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ অভিবর্তন সম্মেলনের পর থেকে প্রতিবছর ১৩টি বাঘ অধ্যুষিত দেশে বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়। তবে বাংলাদেশে এবারের চিত্র হতাশাজনক। একসময় যেখানে প্রায় ৪০০ বাঘ ছিল, বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ১২৫টিতে। ২০১৮ সালে সুন্দরবনের বাঘ ছিল ১১৪টি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ক্যামেরা ট্র্যাপ জরিপ অনুযায়ী, বেড়ে তা হয়েছে ১২৫। যদিও ৮ বছরে ১১টি বৃদ্ধিকে বিশেষজ্ঞরা আশাব্যঞ্জক মনে করছেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মনিরুল এইচ খান বলেন, “বাঘ হত্যা একটি অপরাধ। বাঘকে মানুষ তাড়া করে, তাদের আবাসভূমি দখল করে। সুন্দরবনে বাঘ এখন নিজের ঘরেও নিরাপদ নয়।” তিনি জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামেও একসময় ১০-১৫টি বাঘ থাকলেও এখন মাত্র ২-৪টি টিকে আছে।
ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে (৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার) ২০০১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১৫টির। বাকি ৪০টি বাঘের মৃত্যুর জন্য দায়ী চোরাশিকারি, স্থানীয় জনতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। শুধু ২০০৭ সালের সিডরে মারা যায় একটি বাঘ, স্থানীয়রা পিটিয়ে মেরেছে ১৪টি, আর চোরাশিকারিরা হত্যা করেছে ২৫টি। এদের উদ্দেশ্য ছিল বাঘের চামড়া, দাঁত, নখ ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করা, যা একসময় নিয়মিত চোরাকারবারির অংশ ছিল।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, একসময় সুন্দরবনে ৪০০ বাঘ ছিল। নজরদারির অভাবে চোরাশিকারিরা তা কমিয়ে দিয়েছে। এ জন্য বন বিভাগকেও দায় নিতে হবে। পাশাপাশি তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, যা সুন্দরবনের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বর্তমান জলবায়ু পরিস্থিতি চলতে থাকলে ২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বাঘের জন্য কোনো উপযুক্ত বাসস্থান অবশিষ্ট থাকবে না। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে সুন্দরবনের বড় একটি অংশ প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তবে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সুন্দরবনে চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্য কমেছে। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ এবং কঠোর নজরদারির কারণে বাঘ হত্যা কমে এসেছে। বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের ২৩ শতাংশ এলাকা থেকে বাড়িয়ে এখন ৫১ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১ জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাসকে বাঘের প্রজনন মৌসুম ঘোষণা করে পর্যটকসহ সব ধরনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “চোরাশিকারি কমেছে, যার ফলে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। বাঘের চলাচল ও প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে স্মার্ট পেট্রোলিং টিম সুন্দরবন পাহারায় রয়েছে।”
বিশ্বে বর্তমানে ১৩টি দেশে মাত্র ৫,৬০০টি বাঘ বেঁচে আছে। এসব দেশের মধ্যে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে নেপাল সফলভাবে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে- সেখানে এক দশকে বাঘ বেড়ে হয়েছে ৩০০-এর বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ সেই পথে পিছিয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র সংরক্ষণের আওতা বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। বাঘকে তার প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধে চলাচল এবং নিরাপদে বাস করার সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি চোরাকারবারি রোধ, বন উজাড় বন্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তা না হলে, বাংলাদেশের বাঘও একদিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যেতে পারে।

