বিশ্ব ইতিহাসে ভূমিকম্প একটি অন্যতম বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ। শত শত বছর ধরে এটি জনপদ ধ্বংস করেছে, লক্ষ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, শহরগুলিকে ধুলায় পরিণত করেছে। আধুনিক যুগে, বিশেষ করে ১৯০০ সালের পর থেকে ভূমিকম্প নিয়ে বিস্তারিত তথ্য ও মাপজোকের ব্যবস্থা চালু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস)।
সেই ১২৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে ইউএসজিএস এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ১০টি ভূমিকম্পের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।
রাশিয়ার কামচাটকায় বুধবারের ভূমিকম্প-
২০২৫ সালের ৩০ জুলাই, রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় কামচাটকা উপদ্বীপে একটি ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। শক্তিমত্তা ও প্রবল ধ্বংসের সম্ভাবনার নিরিখে এই ভূমিকম্পটিকে ইতোমধ্যে ইউএসজিএস অনানুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের ষষ্ঠ শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এই ভূমিকম্পের প্রভাবে হাওয়াই উপকূলে চার ফুট উচ্চতার সুনামি ঢেউ আছড়ে পড়ে, জাপানের উত্তরাঞ্চলেও দেখা দেয় জলোচ্ছ্বাস।
কিন্তু এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়— বিগত শতাব্দীতে এমন আরও বহু ভয়াবহ ভূমিকম্প বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। নিচে ইউএসজিএস-এর তালিকা অনুযায়ী, ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী ১০টি ভূমিকম্পের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
১০. সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া– ২০১২ (৮.৬ মাত্রা): ২০১২ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে ৮.৬ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংঘর্ষের ফলাফল। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কম্পন অনুভূত হলেও সৌভাগ্যবশত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল সীমিত। অধিকাংশ প্রাণহানির কারণ ছিল আতঙ্কজনিত হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ।
৯. আসাম-তিব্বত, ভারত/চীন– ১৯৫০ (৮.৬ মাত্রা):
১৯৫০ সালের ভূমিকম্পটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচলে আঘাত হানে। এটি চীন সীমান্তবর্তী তিব্বত অঞ্চলেও প্রবলভাবে অনুভূত হয়। এই ভূমিকম্পে ৭৮০ জন নিহত হন। ব্যাপক ভূমিধস, ভূপৃষ্ঠ ফাটল এবং সড়কপথ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। আজও এটি আসাম-তিব্বত ভূমিকম্প নামে পরিচিত।
৮. র্যাট দ্বীপ, আলাস্কা– ১৯৬৫ (৮.৭ মাত্রা): যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের র্যাট দ্বীপে ১৯৬৫ সালে একটি ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এই দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় জনবসতি কম থাকায় কোনো প্রাণহানির তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে এটি বৈজ্ঞানিক মহলে গভীর আলোচনার জন্ম দেয়।
৭. এসরোলডাস, ইকুয়েডর– ১৯০৬ (৮.৭ মাত্রা): ১৯০৬ সালে ইকুয়েডরের এসরোলডাস শহরে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর মাত্রা ছিল ৮.৭। এতে প্রাণ হারান প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন। কম্পন এতটাই প্রবল ছিল যে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর তীরের সান ফ্রান্সিসকোতেও তা অনুভূত হয়।
৬. কিউরিহিউ, চিলি– ২০১০ (৮.৮ মাত্রা): ২০১০ সালে চিলির বিওবিও প্রদেশের কিউরিহিউ শহরে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫২৩ জন নিহত হন এবং প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটির ইতিহাসে এটি অন্যতম ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত।
৫. কামচাটকা, রাশিয়া– ১৯৫২ (৯.০ মাত্রা): ১৯৫২ সালে কামচাটকা উপদ্বীপেই হয় বিশ্বের প্রথম রেকর্ডকৃত ৯ মাত্রার ভূমিকম্প। হাওয়াই পর্যন্ত এই ভূকম্পন ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে সুনামিও সৃষ্টি হয়। তবে প্রাণহানির নির্দিষ্ট তথ্য না মিললেও রাশিয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
৪. হোক্কাইডো, জাপান– ২০১১ (৯.১ মাত্রা): ২০১১ সালে জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপে ঘটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামি। এতে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান এবং বাস্তুচ্যুত হন অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। এটি ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনারও জন্ম দেয়।
৩. সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া– ২০০৪ (৯.১ মাত্রা):
২০০৪ সালের ভূমিকম্পটি ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয়। ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট ভয়াবহ সুনামিতে অন্তত ২ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, বাস্তুচ্যুত হন ১০ লাখেরও বেশি। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে।
২. আলাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র– ১৯৬৪ (৯.২ মাত্রা): ১৯৬৪ সালের ভূমিকম্পটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পে প্রায় ১৩০ জন প্রাণ হারান এবং ক্ষয়ক্ষতি হয় ২৩০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। এতে সৃষ্ট সুনামি বহু শহর প্লাবিত করে।
১. ভ্যালদিভিয়া, চিলি– ১৯৬০ (৯.৫ মাত্রা): বিশ্ব ইতিহাসে আজ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পটি হয় ১৯৬০ সালে চিলির ভ্যালদিভিয়ায়। ৯.৫ মাত্রার এই ভূমিকম্পে নিহত হন প্রায় ১ হাজার ৬৫৫ জন এবং ২০ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। প্রশান্ত মহাসাগরজুড়ে সৃষ্ট সুনামি হাওয়াই, জাপান, ফিলিপাইন পর্যন্ত আঘাত হানে।
নতুন ভূমিকম্পটির অবস্থান কোথায়?
২০২৫ সালের ৩০ জুলাই কামচাটকা ক্রাই অঞ্চলে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি পৃথিবীর ইতিহাসে ষষ্ঠ বৃহত্তম হিসেবে ঘোষণা করেছে (ইউএসজিএস)। এটি আগের ২০১০ সালের চিলি ভূমিকম্পের সমতুল্য। ভূমিকম্পের পরপরই হাওয়াই, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলসহ বিভিন্ন দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এই কম্পনের পর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী ১০ ভূমিকম্প ও তাদের প্রভাব:
১৯০০ সালের পর থেকে ইউএসজিএস রেকর্ডকৃত তথ্য অনুযায়ী নিচের তালিকায় ১২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ভূমিকম্পগুলো নিম্নরূপ:

অদ্যতন ঘটনায়— রাশিয়ার ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প (জুলাই ৩০, ২০২৫):
-
স্থান: রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপ— Petropavlovsk‑Kamchatsky উপকূলে
-
ম্যাগনিচিউড: ৮.৮ (ইউএসজিএস অনুমান অনুযায়ী)
-
ক্ষতির অবস্থা: সেভেরো-কুরিলস্ক শহরে ভবন ক্ষতিগ্রস্ত, আহত হয়েছেন অনেকে; একাধিক দেশ ও অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা (জাপান, হাওয়াই, মার্কিন পশ্চিম উপকূল ইত্যাদি)। এখনও বড় প্রাণঘাতী খবর পাওয়া যায়নি কিন্তু এই ধাক্কা এখনো চলছে ও আশপাশের উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর ইতিহাস তুলে ধরলে বোঝা যায়, ভূমিকম্প এক ধরনের নীরব ঘাতক- যা মুহূর্তেই জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সত্ত্বেও এখনো মানুষ ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস দিতে পারেনি। তবে ইতিহাস জানলে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হতে পারে।

