বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার এক শান্ত কোণে গড়ে উঠেছে ‘পলাশ একাডেমি পাবলিক লাইব্রেরি’- একটি জ্ঞানের বাতিঘর। যা শুধু বইয়ের ভাণ্ডার নয় বরং এক অনন্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষ জড়ো হয়; স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, কৃষক, চাকরিপ্রার্থী- সবাই মিলে গড়ে তুলছে এক নতুন পাঠাভ্যাস, যা ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে সমাজের চেহারা এবং দেশের উন্নয়নের ভিত্তি।

পাঠক ও বইয়ের বৈচিত্র্য-
পলাশ একাডেমি লাইব্রেরির সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো এর ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় বই সংগ্রহ। এখানে যেমন আসেন সাধারণ পাঠক, তেমনি আসেন শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সাংবাদিক, চাকরিপ্রার্থী, শিশু-কিশোর, কৃষক ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা। প্রত্যেকের জন্যই আলাদা আলাদা পাঠ্য ও গবেষণাভিত্তিক বই রাখা হয়েছে।
- সাধারণ পাঠকদের জন্য রয়েছে: (বাংলা ও বিদেশি সাহিত্য, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, ইতিহাস, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি এবং বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রপাঠ্য বই ও ভর্তি প্রস্তুতির সহায়ক গ্রন্থ)।
- চাকরিপ্রার্থীদের জন্য রয়েছে: (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, কারেন্ট ওয়ার্ল্ড, বিসিএস অ্যাসিওরেন্স ও ব্যাংক গাইড)।
- শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে: (বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা-তাত্ত্বিক বই, পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষাবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাপত্র ও জার্নাল)।
- চিকিৎসকরা পড়তে পারেন: (রিসার্চ জার্নাল (Lancet, BMJ), স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিন)-এর মতো আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সাময়িকী।
- ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য রাখা হয়েছে: (সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল, কম্পিউটার ও মেকানিক্যাল টেকনিক্যাল বই, সফটওয়্যার গাইড এবং আইইইই জার্নালের সমমানের গবেষণা সামগ্রী)।
- আইনজীবীরা পড়তে পারেন: (সংবিধান, বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা, কেস স্টাডি ও ল’ জার্নাল)।
- সাংবাদিক ও লেখকদের জন্য রয়েছে: (সাংবাদিকতার ইতিহাস, নীতিমালা, সম্পাদকীয় সংকলন ও গবেষণামূলক বই)।
- শিশু ও কিশোরদের জন্য রয়েছে: (গল্প, ছড়া, রঙিন বই, সায়েন্স ফিকশন, পাজল ও শিক্ষামূলক বই)।
- কৃষক ও প্রযুক্তিনির্ভর পেশাজীবীদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বই, হস্তশিল্প, গৃহস্থালি ও কারিগরি গাইড সংরক্ষিত রয়েছে।
- পাশাপাশি ইসলামী বই যেমন তাফসির, হাদিস ও ইসলামী ইতিহাসভিত্তিক বইও লাইব্রেরির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগ্রহই পলাশ একাডেমি লাইব্রেরিকে বানিয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকেন্দ্র।

পাঠাভ্যাস ও সামাজিক পরিবর্তন-
পাঠাভ্যাস শুধু জ্ঞান আহরণের মাধ্যম নয়, এটি মনন ও নৈতিকতার উন্নয়নেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বই মানুষকে যুক্তি চর্চায় দক্ষ করে তোলে, সহানুভূতি ও মানবিকতা শেখায় এবং সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করে। পলাশ একাডেমি লাইব্রেরিতে নিয়মিত আসা একজন তরুণ তার স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, একজন কৃষক আধুনিক কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করছে, আর শিক্ষক নতুন পাঠদান পদ্ধতি আয়ত্ত করছে। বিসিএসে সাফল্য পাওয়া অনেক ছাত্রের পিছনে এই লাইব্রেরির অবদান অনস্বীকার্য। সাংবাদিকরা তথ্য যাচাই ও প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেও এখানে আসে।

এইভাবে লাইব্রেরি হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত কেন্দ্র, যেখানে শুধু বইয়ের পাতায় নয় বরং মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কে আলোর ছড়াছড়ি হয়। পলাশ একাডেমির পাঠাগার এক নতুন বরিশাল, এক সচেতন বানারীপাড়া এবং আলোকিত সমাজ গঠনের অগ্রদূত।
মেধা বিকাশ ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি-
বইপাঠের মাধ্যমে শুধু বই মুখস্থ নয়, মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব। শিশুরা যখন কমিক্স, সায়েন্স ফিকশন ও গল্প পড়ে, তাদের কল্পনাশক্তি ও বিশ্লেষণক্ষমতা বাড়ে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ইতিহাস, সাহিত্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক বই পড়ে জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করে। পলাশ একাডেমির বইয়ের বৈচিত্র্য শিশু থেকে প্রবীণ সকলের মেধাকে উদ্দীপ্ত করে।

বইপাঠের গুরুত্ব: ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন-
একটি সমাজ যখন বইপাঠের সংস্কৃতি গড়ে তোলে, তখন সেই সমাজ হয়ে ওঠে সচেতন, মানবিক ও দায়িত্ববান। বই পড়া মানুষকে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সম্প্রীতির বিকাশে সহায়ক। এই ধরনের সচেতন সমাজ গড়ে তোলে শক্তিশালী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র। অর্থাৎ, বইপাঠ ব্যক্তিগত উন্নয়ন ছাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নেরও অন্যতম প্রধান ভিত্তি।
ডিজিটাল যুগের ব্যস্ততা ও মনোযোগের সংকটের মাঝেও নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস মানুষকে ধৈর্যশীল, বিশ্লেষণক্ষম ও দায়িত্ববান করে গড়ে তোলে। তাই পলাশ একাডেমি লাইব্রেরির অবদান শুধু জ্ঞানের প্রসারে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এক সুস্থ ও উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে।
প্রতিবেদক: এফ.আর. ইমরান (নিউজ ইডিটর, সিটিজেনস ভয়েস)

