ঢাকাই মসলিন—একসময়ের বিলুপ্তপ্রায় তাঁতশিল্প, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ড ও বস্ত্র প্রকৌশলীদের উদ্যোগে পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটতে শুরু করে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল অতীতের অপূর্ব সুতিবস্ত্রকে নতুন প্রজন্মের জন্য পুনরায় বোনা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া।
মিরতিকাতে শাড়ি পিঁপড়ার মতো হালকা মসলিনের কথা স্থানীয় ময়মনসিংহের লোকগীতিতেও পাওয়া যায়। ঢাকার মসলিনের তুলনাহীন সূক্ষ্মতা ও হালকাপনা পৃথিবীর অন্য কোনো কাপড়ে দেখা যায় না। আকাশের মতো নির্মল, স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ এবং পাখির পালকের মতো হালকা এই মসলিনকে ‘বোনা বাতাস’ বা ‘হাওয়ার ইন্দ্রজাল’ বলা হতো। কিংবদন্তি অনুযায়ী, একটি শাড়ি আঙুলের আঙটিতে গুঁজে রাখা যেত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বাজার দখল ও কারিগর নিপীড়নের ফলে মসলিন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

ঢাকাই মসলিনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর সূক্ষ্ম বুনন। মিহি মসলিন শাড়ির জন্য অত্যন্ত নাজুক সুতা ব্যবহার করা হতো। সেই সুতা কাটা হতো শিশির ভেজা সময়ে বা কৃত্রিম আর্দ্রতায়, শুধুমাত্র স্পর্শকাতর আঙুলের মালিক মেয়ে কারিগররা এটি করতে পারতেন। সূক্ষ্ম সুতা এতটাই নাজুক ছিল যে প্রখর সূর্যের তাপেও ছিঁড়ে যেত।
মসলিনের গুণমান নির্ভর করত থ্রেড কাউন্টের ওপর। প্রতিটি বর্গ ইঞ্চি কাপড়ে লম্বা ও আড়াআড়ি কতগুলো সুতা রয়েছে, তা নির্ধারণ করত কাপড়ের মোলায়েমতা ও টেকসই হওয়া। ঢাকাই মসলিনের থ্রেড কাউন্ট ৮০০ থেকে ১২০০-এর মধ্যে থাকত, যা জামদানি তুলনায় বহু গুণ বেশি। এর ফলে কাপড় হয়তো নরম, কিন্তু একই সঙ্গে টেকসই।

মসলিনকে বিভিন্ন ধরনের নাম দেওয়া হতো, যেমন মলমল, আব-ই-রাওয়ান, শবনম, শরবন্দ, তনজেব, নয়নসুখ, বদনখাস্। এই নামগুলো বেশির ভাগই ফার্সি বা আরবি থেকে উদ্ভূত।
১৭১৮ সালে ঢাকাই মসলিন ছিল বাংলার প্রধান রপ্তানি পণ্য। লন্ডন, প্যারিস, রোমসহ বিশ্ববিখ্যাত শহরে এটি আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। এক গজ মসলিনের দাম তখন ৫০ থেকে ৪০০ পাউন্ড, বর্তমান মূল্যে সাত হাজার থেকে ৫৬ হাজার পাউন্ড। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় করের চাপ, তুলা চাষের সীমিততা এবং মিল-শিল্পের একচেটিয়া নীতির কারণে মসলিন উৎপাদন ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বিলুপ্তির দেড় শতাব্দী পর, ২০১৪ সালে মসলিন পুনরুদ্ধারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ফুটি কার্পাস গাছের সন্ধান, বীজ সংগ্রহ, তুলা চাষ এবং প্রাচীন বুনন কৌশল পুনরায় আবিষ্কার করা। দীর্ঘ ছয় বছরের গবেষণার পর তাঁতশিল্পীরা জামদানি বুননের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০২০ সালের শেষ দিকে ৫০০ কাউন্টের মসলিন শাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হন। ডিসেম্বরে এটিকে ‘জিওগ্রাফিক্যাল এনডিকেশন (জিআই)’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে ঐতিহ্য রক্ষা করে।
২০২০ সালে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে নতুন মসলিন প্রদর্শিত হয় এবং প্রশংসিত হয়। ২০২২ সালে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকাই মসলিনের পুনর্জন্ম ঘোষণা করে নারায়ণগঞ্জের তারাবোতে ‘ঢাকাই মসলিন হাউজ’ প্রতিষ্ঠা করে। এখানে ৬০ জনেরও বেশি প্রশিক্ষিত কারিগর কাজ করছেন, যারা জামদানি বা অন্যান্য তাঁতের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। আন্তর্জাতিক বাজারে ঢুকতে মসলিন প্রস্তুত করা হচ্ছে।

ঢাকাই মসলিনের পুনর্জাগরণ শুধু কাপড়ের নান্দনিকতা নয়, এটি বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নদীভিত্তিক কৃষি ও শিল্পকৌশলের প্রতীক। অতীতের গর্ব, বর্তমানের সাফল্য আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মিশে আছে এই সুক্ষ্ম সুতায়। আজ এটি তরুণ ডিজাইনারদের অনুপ্রেরণা এবং বাংলাদেশের কারুশিল্পের পুনর্জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
ঢাকাই মসলিনের পুনর্জাগরণ ইতিহাসের কাছে দায় মেটানোরও প্রচেষ্টা। হারানো ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের হাতে ফিরে এসেছে, যা কেবল বাংলার গৌরব নয়, আন্তর্জাতিক মানের কারুশিল্পের প্রতীক হিসেবেও স্থান করে নেবে।

