এক বছরের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হচ্ছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই চ্যালেঞ্জ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
দেশের সাধারণ মানুষ যেমন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছে, তেমনি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ও বিশেষজ্ঞরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা ও প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন ঘোষণার পর এই প্রশ্ন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, আসন্ন নির্বাচনের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী পুরোপুরি প্রস্তুত। তার মতে, নির্বাচন করার জন্য এখনও হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। “নির্বাচনে কোনো অসুবিধা হবে না, আমাদের লক্ষ্য একটি শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন করা” তিনি বলেন।

পুলিশ সদর দপ্তর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র, আশেপাশের এলাকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী দায়িত্বে পুলিশ সদস্যদের সক্ষম করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ও ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং ইতিপূর্বে লুণ্ঠিত ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া নির্বাচনকালীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে ‘জাতীয় তথ্য কেন্দ্র’ গঠন করা হচ্ছে।
বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা, প্রয়োজনীয় যানবাহন ও নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহসহ পুলিশের লজিস্টিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পুলিশ সদস্যদের বদলি লটারির মাধ্যমে করা হবে। সাধারণ পুলিশ সদস্য যারা এখনও মনোবলহীন বা আতঙ্কিত, তাদের জন্য নির্বাচনকালীন প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া, প্রিসাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় ‘অস্ত্রসহ আনসার’ মোতায়েন করা হবে। সেনাবাহিনী নিয়মিত ডিউটিতে অংশগ্রহণ করবে, সীমান্ত এলাকায় বিজিবি দায়িত্ব পালন করবে এবং নৌ সীমান্তে কোস্ট গার্ড মোতায়েন থাকবে।

রাজনৈতিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বিগত সরকারের আমলে নির্বাচনী ব্যবস্থার অবনতি ঘটেছিল। তাই নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং পুলিশকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো হবে। তারা আশা করছেন, এবার শুধু পুলিশ নয়, সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণও থাকবে। সেনাবাহিনী এবার রিজার্ভ নয়, বরং নিয়মিত ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। ফলে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে— ভোটকেন্দ্রের আশপাশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা, পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের এই উদ্যোগ যথেষ্ট হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্ষমতা ও মনোবল আগামী নির্বাচনের সুষ্ঠু সম্পন্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, “নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন চ্যালেঞ্জিং হলেও, বর্তমান পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তিত। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার আলোকে পুলিশ কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করবে। সেনাবাহিনী এবার নিয়মিত ফোর্স হিসেবে থাকবে, তাই খুব জটিল অবস্থা হবে না।”

নির্বাচনী দায়িত্ব ও প্রশিক্ষণ-
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম জানিয়েছেন, ৩১ আগস্ট থেকে পুলিশ প্রশিক্ষণ শুরু করবে। ঢাকার বাইরে প্রশিক্ষণ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে। এই প্রশিক্ষণ নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে পুলিশকে সক্ষম করবে। অতীতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা কম ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর অনেক নতুন পুলিশ নিয়োগ পেয়েছেন, যারা এখনও দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত নন। প্রশিক্ষণে তাদেরকে বাস্তবিকভাবে দায়িত্ব পালনের ধরণ দেখানো হবে।
জেলাপর্যায় পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আইজিপি জানান, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এক লাখ ৫০ হাজার পুলিশকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তুলবে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাবে।

নির্বাচনী লজিস্টিক ও যানবাহন-
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে পুলিশের যানবাহন ও স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে যানবাহনের সংকট মোকাবিলায় চার শতাধিক নতুন গাড়ি কেনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, আগামী মাস থেকেই নতুন গাড়ি পাওয়া শুরু হবে।
বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি-
নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কমপক্ষে ৪০ হাজার বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় এই পদক্ষেপ আলোচনা করা হয়েছে। বডিক্যামগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং পুলিশকে দায়িত্ব পালনে আরও সক্ষম করবে।

প্রিসাইডিং অফিসারের নিরাপত্তা: অস্ত্রসহ আনসার-
প্রিসাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় এবার হাতে অস্ত্রসহ আনসার থাকবে। আগে নির্বাচনে চারজন নারী ও ছয়জন পুরুষ আনসার দায়িত্ব পালন করত কিন্তু তাদের হাতে অস্ত্র থাকত না। এবার অস্ত্রসহ তিনজন আনসার থাকবে। আনসার ছাড়াও পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে।
স্থল ও নৌ-সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড-
নৌ ও স্থল সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজিবি ও কোস্ট গার্ড পূর্বেই মোতায়েন থাকে। এবারও তারা দায়িত্ব পালন করবে, তবে এবার সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ আরও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হবে।

লুণ্ঠিত অস্ত্র ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ-
গত ৫ আগস্ট পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ প্রায় ছয় হাজার অস্ত্র অন্তর্ভুক্ত। এখনো প্রায় ১,৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই লুণ্ঠিত অস্ত্র নির্বাচনকালে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হবে এবং যারা সন্ধান দেবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে।

আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করার কমিটমেন্ট জরুরি-
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান মাছউদ বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পলাতক অপরাধী বা জঙ্গি গ্রেপ্তার এবং লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ হলেও শক্তিশালী কমিটমেন্টের মাধ্যমেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব।”
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতামত-
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব শুধু সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। এটি সবার দায়িত্ব। নির্বাচন পেছালে বা বিঘ্নিত হলে দেশে আরেকটি রক্তগঙ্গা বইতে পারে। তাই সবার সহযোগিতা অপরিহার্য।”

