ঢাকা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের টানাপোড়েন বহুদিনের। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ হলেও বাস্তবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কূটনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী নয়াদিল্লি বা ইসলামাবাদে ঝুঁকেছে। ফলে, বাংলাদেশ কোন দেশের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠ, তা প্রায়শই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করেছে।
এই পুরোনো টানাপোড়েন নতুন করে আলোচনায় এসেছে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সাম্প্রতিক ঢাকা সফর ঘিরে। ২৩ আগস্ট দুই দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছে তিনি যেন জনমনে আবারও প্রশ্ন তুলেছেন—‘ঢাকা আসলে কার ঘনিষ্ঠ?’ পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডন এবং ভারতীয় পত্রিকা দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয় বিশ্লেষণও এই প্রশ্নকে আরও উস্কে দিয়েছে।
ডনের ২৬ আগস্ট প্রকাশিত সম্পাদকীয় ‘Ties That Bind’ ‘টাইস দ্যাট বাইন্ড’-এ বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে ইসলামাবাদ-ঢাকা সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এই সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা শুরু হয়েছে। প্রায় ১৩ বছর পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর হওয়ায় ইসহাক দারকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে বলে সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এই সফরে সম্পর্ক গভীর করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার কথাও বলেছেন।

তবে ডন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিয়োগান্তক ইতিহাস ও দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি বিভাজনের কথাও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। পত্রিকাটি স্মরণ করিয়ে দেয়, ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে ১৯৭১ সালের হত্যাযজ্ঞের জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা আশা করে আসছে এবং আটকে পড়া উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ফেরত পাঠানোর প্রশ্নেও সমাধান হয়নি। যদিও ইসলামাবাদ মনে করে এই প্রশ্নের উত্তর বহু আগেই দেওয়া হয়েছে।
ডনের সম্পাদকীয়তে দাবি করা হয়, শেখ হাসিনার সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রসঙ্গ ব্যবহার করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে শত্রুতাপূর্ণ রেখেছিল এবং একই সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে করেছে উষ্ণতর। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের বাতাস বইছে—হাসিনা সরকারের পতন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং মুদ্রা থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরানোর ঘটনা এর প্রতিফলন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
সম্পাদকীয় আরো জানায়, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২০০২ সালে ঢাকায় সফরকালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর জন্য ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছিলেন। ডনের মতে, অতীতের এই বেদনাদায়ক অধ্যায় স্বীকার করে দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী শত্রুতা দূর করা উচিত।
পত্রিকাটি বাংলাদেশের সার্ক পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাবে সদিচ্ছা প্রকাশ করলেও ভারতের অনীহা ও একগুঁয়েমির কারণে বিষয়টিকে অবাস্তব বলেছে। বরং চীন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সহযোগিতার সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

অন্যদিকে ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু একই দিনে ‘Friends and Foes: On Bangladesh-Pakistan Ties’ ‘ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফোস: অন বাংলাদেশ-পাকিস্তান টাইস’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনেন। এ কারণে ইসলামাবাদ-ঢাকা সম্পর্ক দ্রুত তিক্ত হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গও সম্পাদকীয়তে এসেছে।
সম্পাদকীয়তে আরো স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, ২০১৫ সালে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বাংলাদেশ একজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে বহিষ্কার করে, পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকেও বাংলাদেশি হাই কমিশনারকে ফেরত পাঠানো হয়।
হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই দেশের সম্পর্ক মেরামতের প্রচেষ্টায় চীনের অবদানের কথাও ‘হিন্দু’ উল্লেখ করেছে। তবে পাকিস্তানের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা, যুদ্ধক্ষতিপূরণ এবং আটকে পড়া উর্দুভাষী নাগরিকদের ফেরত পাঠানো—এসব বিষয়ে বাংলাদেশি নেতৃত্ব কোনো উদ্যোগ নেবে না বলে জানিয়েছে পত্রিকাটি।
দ্য হিন্দু সম্পাদকীয় জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সার্ককে কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব দেন। তবে ভারত পাকিস্তান-ঢাকা সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখছে। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের জামায়াতে ইসলামীপন্থী ছাত্র সংগঠনকে সমর্থনের অভিযোগও উল্লেখ করা হয়েছে।

পত্রিকাটি সতর্ক করে দিয়েছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক ও গোয়েন্দা যোগাযোগ নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগের কারণ। ভারতের প্রতি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ঢাকা-ইসলামাবাদ ঘনিষ্ঠতা বাস্তবসম্মত দৃষ্টিতে দেখা উচিত। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎ এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকের কথাও এসেছে আলোচনায়।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের উচিত সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সম্পাদকীয়র মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে কার্যত কোনো আঞ্চলিক জোট না থাকায় নয়াদিল্লির পক্ষে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে প্রভাব বিস্তার কঠিন হয়ে পড়েছে।
এইভাবে ইসহাক দারের সফর শুধু কূটনৈতিক বিনিময় নয়, বরং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতার নতুন ইঙ্গিতও দিচ্ছে।

