বাংলাদেশে ইস্পোর্টস জগতে প্রবেশ অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় দেরিতে হলেও বর্তমানে এই শিল্প দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। দীর্ঘ সময় ‘সময় নষ্ট’ হিসেবে গেমিংয়ের প্রতি নেতিবাচক ধারণা থাকলেও এখন তা পেশার রূপ নিতে শুরু করেছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশের তরুণরা প্রাথমিকভাবে বন্ধুদের সঙ্গে মজার ছলে ভিডিও গেম খেললেও- এখন তারা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার অর্জন করছে।
২০২৩ সালে রেভান নামে পরিচিত এক খেলোয়াড়কে দেশের তরুণ ইস্পোর্টস কমিউনিটি বিশেষভাবে চিনতে শুরু করে। তার শুরু ছিল মোবাইল ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে পাবজি খেলার মাধ্যমে। রেভান স্মৃতিচারণা করেন, “শুধু আনন্দের জন্য খেলতে শুরু করেছিলাম। তবে প্রথম অফিসিয়াল টুর্নামেন্ট ‘পাবজি মোবাইল ক্লাব ওপেন’-এ অংশ নিয়ে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিলাম। এরপর প্রো-লিগের জন্যও নির্বাচিত হই এবং মানুষ আমাকে চিনতে শুরু করে।”
রেভানের সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি বাংলাদেশে ইস্পোর্টসের অগ্রগতির প্রতিফলন। এখন তরুণরা গেমিংকে শুধু শখ নয়, পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে। রেভানও স্পন্সরশিপ, কনটেন্ট তৈরি এবং স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে আয় করছেন। একসময় যেসব ছেলে-মেয়ে বাড়িতে কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকানোর জন্য বকুনি খেত, আজ তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিযোগিতা করছে।
বৈশ্বিক ইস্পোর্টস ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা-
ইস্পোর্টস এখন ছোটখাটো খেলা নয়, এটি একটি বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক শিল্পে রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক ইস্পোর্টস বাজারের আকার প্রায় ২১০ কোটি ডলার ছিল। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৭৫০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে এবং ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক বৃদ্ধি ২৩ শতাংশের বেশি হবে।
এই খেলায় খেলোয়াড়রা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। দর্শকরা অনলাইনে বা সরাসরি অ্যারেনায় বসে হাজার হাজার মানুষ সেই খেলা উপভোগ করেন। বাংলাদেশের তরুণ খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক ইভেন্টে যোগ্যতা অর্জন করছে, যেমন পাবজি মোবাইল আঞ্চলিক ইভেন্ট, ফ্রি ফায়ার টুর্নামেন্ট এবং স্ট্রিট ফাইটার ও ই-ফুটবল-এর বাছাইপর্ব।
‘স্ট্রিট ফাইটার’ খেলোয়াড় এসআই অনিক বলেন, “২০২৩ সালে আঞ্চলিক বাছাইপর্বে অংশ নেওয়ার পরেই আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। খেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের জন্য বড় মাইলফলক। এখন আমরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাচ্ছি। পুরস্কারের অর্থও আমাদের উৎসাহিত করছে।”
বাংলাদেশের ইস্পোর্টসের অগ্রগতি-
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, কম দামে স্মার্টফোন এবং ইউটিউব-ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট দেখার সুযোগ নতুন প্রজন্মের জন্য সুবিধা সৃষ্টি করেছে। এখন দেশে নিয়মিত স্থানীয় প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো টুর্নামেন্টে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, ছোট আয়োজকরা কয়েক লাখ টাকার পুরস্কার দিয়ে প্রতিযোগিতা আয়োজন করছেন।
জেনিটিক ইস্পোর্টসের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলিউর রহমান বলেন, “প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব এখন বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে। সরকারি স্বীকৃতি ও নীতিমালা গঠনের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, যা ইস্পোর্টস খাতকে আরও পেশাদারী ও স্বচ্ছ করবে।”
সামাজিক বাধা ও নেতিবাচক ধারণা-
যদিও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে দেশীয় খেলোয়াড়রা, তবুও সমাজে গেমিং নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও শক্তিশালী। রেভান মনে করেন, পুরোনো প্রজন্মের ভুল ধারণা দূর করা সবচেয়ে কঠিন। “অনেক বাবা-মা মনে করেন গেমিং পড়াশোনা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু দায়িত্বশীলভাবে খেললে এটি শখ বা পেশা হিসেবে পরিণত হতে পারে।”
আরেকটি ভুল ধারণা হলো, ইস্পোর্টসকে জুয়ার সঙ্গে যুক্ত করা। জনপ্রিয় ফ্রি ফায়ার খেলোয়াড় কাফি কাশফি বিমানবন্দরে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি বলেন, “ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বারবার জানতে চেয়েছেন- এটি জুয়া কি না।”
অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগত চ্যালেঞ্জ-
ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা, ‘হাই পিং’ এবং পেশাদার মানের কম্পিউটার বা গেমিং ফোনের উচ্চমূল্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বড় বাধা। এছাড়া কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুপস্থিতি স্বচ্ছতা ও সমান সুযোগের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। রেভান বলেন, “সঠিক নিয়মকানুন না থাকলে খেলোয়াড়দের ওপর আস্থা তৈরি করা কঠিন।”
একই সঙ্গে, নির্দিষ্ট গেমের জনপ্রিয়তার কারণে অন্য গেমের খেলোয়াড়রা প্রায়ই উপেক্ষিত বোধ করেন। অনিক বলেন, “সব গেমকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নতুন খেলোয়াড়দের জন্য পেশাদার কোচ এবং আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।”
সরকারি স্বীকৃতি ও নীতিমালা-
চলতি বছর ১৪ জুলাই সরকার ইস্পোর্টসকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ক্রীড়া’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন-২০১৮ অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং খসড়া নীতিমালা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করেছে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল আহসান বলেন, “খসড়া নীতিমালায় সামাজিক নেতিবাচক ধারণা মোকাবিলা ও আসক্তি প্রতিরোধের রূপরেখা অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতে ইস্পোর্টস ফেডারেশন গঠিত হলে বাজেট, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টের সুযোগ সৃষ্টি হবে।”
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা-
ইস্পোর্টস ইতিমধ্যেই আংশিক স্বাবলম্বী শিল্পে পরিণত হয়েছে। স্ট্রিমাররা বিজ্ঞাপন ও ভক্তদের অনুদান থেকে আয় করেন, পেশাদার খেলোয়াড়রা টুর্নামেন্ট পুরস্কার ও ব্র্যান্ড স্পনসরশিপ থেকে উপার্জন করেন। আলিউর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে ইস্পোর্টস বাজারের নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও জনপ্রিয় গেমাররা মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এ খাতকে আরও বিনিয়োগ আকর্ষণীয় করবে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা-
খেলোয়াড়রা আরও প্রশিক্ষণকেন্দ্র, বৃত্তি, জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্ট এবং উন্নত ইন্টারনেট সুবিধার প্রত্যাশা রাখছেন। ব্যাডরেভ বলেন, “সরকারকে এমন সুসংগঠিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে যা খেলোয়াড়, আয়োজক ও কনটেন্ট নির্মাতাদের সুরক্ষা দেবে। এটি পেশাদার পরিবেশ উন্নত করবে এবং নেতিবাচক ধারণা দূর করতে সাহায্য করবে।”
কমিউনিটি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গেমিংকে পেশা হিসেবে প্রচার করছে। কাফি বলেন, “আমরা সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনা তুলে ধরছি। এর ফলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বাবা-মায়েরা এখন গর্বের সঙ্গে দেখেন তাদের সন্তান আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।”
তবে চূড়ান্ত সাফল্য পেতে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ব্যাডরেভ মনে করেন, “সুপ্রতিষ্ঠিত নীতিমালা, সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে এবং দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে।”