দুনিয়াজুড়ে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে অবহেলা করে চলা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের কারণে মানুষসহ প্রাণীজগৎ আজ চরম ঝুঁকিতে। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড নেশন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এবার ৩৩ বছর পূর্ণ করল।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১০ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রাজিলের বেলিম শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৩০তম কপ বা জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন। সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন বিশ্বনেতা, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিনিয়োগকারী, নাগরিক প্রতিনিধি, উন্নয়ন সহযোগী এবং করপোরেট ব্যবসায়ীর মতো বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার।
সম্মেলনটি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে নতুন চুক্তি, উদ্যোগ এবং প্রযুক্তি আলোচনা করার গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিগত ২৯টি জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতারা পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও জনগোষ্ঠীর জন্য ‘মিটিগেশন’, ‘অভিযোজন’ ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সহায়তা প্রদানে নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে ক্ষতিপূরণ, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মূল প্রতিশ্রুতিগুলো নিম্নরূপ:
- প্রথম কপ (১৯৯৫, বার্লিন, জার্মানি): উন্নত দেশগুলো ২০০০ সালের মধ্যে ১৯৯০ সালের কার্বন নির্গমনের পর্যায়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
- কপ৩ (১৯৯৭): ‘কিয়োটো প্রটোকল’ স্বাক্ষরিত হয়। এতে শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলো (অ্যানেক্স-এ দেশ) গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।
- কপ২১ (২০১৫): প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সর্বজনীন ও আইনি বাধ্যবাধকতামূলক। সব রাষ্ট্র গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ প্রশমন, অভিযোজন ও অর্থায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
- কপ২৬ (২০২১, গ্লাসগো): জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণ ধাপে ধাপে হ্রাস অথবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া অভিযোজনের অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
- কপ২৮ (২০২৩, দুবাই): জলবায়ু ক্ষতিপূরণ তহবিল (লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড) গঠন ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য মূল্যায়ন এবং কৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
- কপ২৯ (২০২৪, বাকু, আজারবাইজান): জলবায়ু অর্থায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধনী উন্নত দেশগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে ন্যূনতম ৩০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করবে। পাশাপাশি প্যারিস চুক্তির ধারার ৬ বাস্তবায়নের জন্য বৃহত্তর আকারে ১.৩ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলারের তহবিল গঠনের বিষয়েও ঐকমত্য হয়।
এ পর্যন্ত যেসব প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি হয়েছে, প্রধানত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। প্রথমটি হলো কার্বনসহ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, দ্বিতীয়টি হলো জলবায়ু ক্ষতি মোকাবেলায় অর্থায়ন। তবে ১৯৯৫ সালের প্রথম সম্মেলনের পরও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়নি। ৩০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে।
গ্লোবাল কার্বন বাজেট (২০২৪) অনুযায়ী: ১৯৯৫ সালে বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ ছিল ২৭.৯ বিলিয়ন টন। ২০২৪ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪১.৬ বিলিয়ন টনে, যা ৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের বৃদ্ধি মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর চাপ তৈরি করেছে। পরিবেশ ও প্রকৃতির অবক্ষয় বেড়েছে। এছাড়া জলবায়ু অর্থায়নের জন্য নানা তহবিল গড়ে উঠলেও প্রান্তিক ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কতটুকু সুবিধা পেয়েছে তা স্পষ্ট নয়। কোন অংশ ঋণ, কোন অংশ সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ—এটি নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গৃহীত প্রতিশ্রুতিগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।
জলবায়ু বীমার ইতিহাস: হাম্মুরাবির বিধি সরাসরি বীমার ধারণা না দিলেও ‘ঝুঁকি ভাগাভাগি’ বা ‘ক্ষতিপূরণ’-এর কিছু নীতি দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও বীমার সদৃশ ধারণা গড়ে উঠেছিল। এটি মূলত একে অপরকে সাহায্য করার পদ্ধতি হিসেবে বিকশিত হয়। প্রাচীন গ্রিকরা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে জীবন ও স্বাস্থ্য বীমার মতো ধারণা তৈরি করে, যা আধুনিক বীমার প্রাথমিক রূপ হিসেবে বিবেচিত।
সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত এই বীমা ব্যবস্থা আজ শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় গোটা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর। ক্লাইমেট ইন্স্যুরেন্স বা জলবায়ু বীমা হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এর প্রথম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে (১৯৯০) জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি প্রশমনে বীমা খাতের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরা হয়।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশে পরীক্ষামূলকভাবে জলবায়ু বীমা কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে ‘প্যারামেট্রিক বীমা’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে কোনো পূর্বনির্ধারিত ঘটনার মাত্রা (যেমন বন্যার পানির উচ্চতা বা বাতাসের গতি) নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছালে তাড়াতাড়ি অর্থ প্রদান করা হয়, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ছাড়াই। তবে এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন রয়েছে।
সিডিআরএফআই : ‘জলবায়ু ও দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়ন ও বীমা’ হলো একটি সমন্বিত কাঠামো। এটি বীমা, পুনর্বীমা, জরুরি তহবিল, ঝুঁকি ভাগাভাগি ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে কাজ করবে। লক্ষ্য হলো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ১০টি দেশে এ কাঠামো পরীক্ষামূলকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে।
কপ২৭-এর ধারাবাহিকতায় গ্লোবাল শিল্ড প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারও নিবিড়ভাবে কাজ শুরু করেছে। গ্লোবাল শিল্ড ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১০ মে বাংলাদেশের যমুনা রিভার সাসটেইনেবল ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পে প্যারামেট্রিক ইন্স্যুরেন্স পদ্ধতিতে ৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বন্যা ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে—তৃণমূলের হতদরিদ্র মানুষ যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন, বাস্তুচ্যুত বা পেশাচ্যুত হয়েছেন, তাদের বীমার প্রিমিয়াম কারা প্রদান করবেন?
বীমা কোম্পানি সাধারণত মুনাফার জন্য কাজ করে। তবে জলবায়ু বিপদাপন্ন মানুষের জন্য বীমা হতে হবে ‘বিশেষায়িত বীমা’। করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটির আওতায় বীমা কোম্পানি একটি স্বতন্ত্র বাণিজ্যিক কাঠামোর মাধ্যমে এই বিশেষায়িত বীমা পলিসি প্রণয়ন করতে পারে। এতে বীমা শুধু বাণিজ্য নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার একটি উপায় হিসেবে কাজ করবে।
পৃথিবীতে জলবায়ু বীমা নিয়ে নানা পর্যায়ে গবেষণা চলছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের একজন হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা, বীমা নীতিমালা যেন জলবায়ু ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রণীত হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সিদ্ধান্ত প্রণয়নকারীরা এ দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রেখে সহজ ও কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। একটি কল্পিত ধারণা হলো ‘বিশেষায়িত জলবায়ু বীমা ও সঞ্চয় স্কিম’। এতে রাষ্ট্র বীমাগ্রহীতার পক্ষে বীমার প্রিমিয়াম প্রদান করবে। দ্বীপ রাষ্ট্র, স্বল্প উন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য আন্তর্জাতিক ‘জলবায়ু তহবিল’ থেকে বীমার প্রিমিয়ামের অর্থ অনুদান হিসেবে নেওয়া হবে।
প্রিমিয়াম পদ্ধতি উদাহরণ: ১০ বছর মেয়াদি একটি প্যারামেট্রিক সাধারণ বীমার বার্ষিক ফেস ভ্যালু ধরা যাক ৫ লাখ টাকা। এক বীমাগ্রহীতা বছরে প্রিমিয়ামের ১০% অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করবেন।
-
যদি সেই বছরে কোনো ঝুঁকির মধ্যে না পড়েন, প্রিমিয়ামের ৮০% অর্থাৎ ৪০ হাজার টাকা বীমা কোম্পানি ঝুঁকি কাভারেজ ও ব্যবস্থাপনার খরচ হিসেবে রাখবে, বাকি ২০% অর্থাৎ ১০ হাজার টাকা বীমাগ্রহীতার সঞ্চয় হিসেবে ফেরত যাবে।
-
যদি ঝুঁকির মধ্যে পড়েন, প্রিমিয়ামের বিনিময়ে ফেস অ্যামাউন্টের নির্ধারিত পুরো টাকা পাবেন।
সঞ্চয় স্কিম:
প্রথম বছরে সম্পূর্ণ ৫০ হাজার টাকা বীমাগ্রহীতা নিজেই প্রদান করবেন। দ্বিতীয় বছর থেকে দশম বছর পর্যন্ত রাষ্ট্র প্রতি বছর ৪০ হাজার টাকা প্রদান করবে, বীমাগ্রহীতা ১০ হাজার টাকা প্রদান করবেন। এই ২০% বীমাগ্রহীতার নিজস্ব সঞ্চয় হিসেবে জমা হবে। বছরভিত্তিক লভ্যাংশসহ ১০ বছরের শেষে এটি উল্লেখযোগ্য মূলধনে রূপ নেবে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে না। এটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব মোকাবেলায় প্রয়োজন মানবাধিকারভিত্তিক বীমা নীতি, যা জলবায়ু বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষায় কার্যকর রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।
শামীম আরফীন: নির্বাহী পরিচালক, অ্যান অর্গানাইজেশন ফর সোশিওইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট।

