সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির শর্তের কারণে বিমা করপোরেশন আইনের পুনর্বিমা (রি-ইনস্যুরেন্স) ধারা বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। ধারাটি বাতিল হলে ব্যবসা কমে যাবে রাষ্ট্রীয় সাধারণ বীমা করপোরেশনের। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি উদ্বিগ্ন।
পুনর্বিমা হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি বিমা কোম্পানি নিজের ঝুঁকি কমাতে অন্য সংস্থা বা পুনর্বিমা কোম্পানির কাছে প্রিমিয়াম দিয়ে ঝুঁকির অংশ বিক্রি করে। এটি কোম্পানির দাবির দায়ভার কমায়। বর্তমানে দেশের ৪৫টি বেসরকারি সাধারণ বিমা (নন-লাইফ) কোম্পানিকে তাদের পুনর্বিমার ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় একমাত্র পুনর্বিমাকারী সংস্থা সাধারণ বীমা করপোরেশনে করতে হয়। বাকি ৫০ শতাংশ পুনর্বিমা তারা সাধারণ বীমা করপোরেশন অথবা বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানে করতে পারে। বাধ্যতামূলক পুনর্বিমার সুবিধার কারণে সাধারণ বীমা করপোরেশন যে আয় করে, তার অর্ধেকই দেশের ৪৫টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। ফলে লাভবান হয় সাধারণ বীমা করপোরেশন এবং দেশের সব বেসরকারি নন-লাইফ বিমা কোম্পানি।
সাধারণ বীমা করপোরেশন সতর্ক করে জানিয়েছে, পুনর্বিমা (রি-ইনস্যুরেন্স) বিষয়ক ধারার আইন সংশোধন হলে চূড়ান্ত অর্থে সরকার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ বলেন, “আমরা বলেছি যে আইন সংশোধন করা হলে চূড়ান্ত অর্থে ক্ষতির মুখে পড়বে সরকার।”
করপোরেশনের আরও একটি আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে সরকারি সম্পত্তি বা বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর বাধ্যতামূলক পুনর্বিমা সাধারণ বীমা করপোরেশনে করতে হয়। নতুন আইনের খসড়ায় সেটি উন্মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এতে বিদেশি কোম্পানির ব্যবসা বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসার সুযোগ বাড়াতেই যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি উন্মুক্ত করার শর্ত দিয়েছে।
সাধারণ বীমা করপোরেশন নতুন আইনের খসড়া নিয়ে উদ্বেগের কথা গত ১১ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, পুনর্বিমা ধারা বাতিল হলে দেশি কোম্পানিগুলো বিদেশে ইচ্ছামতো পুনর্বিমা করতে পারবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাবে। পাশাপাশি পুনর্বিমা প্রিমিয়াম পরিশোধে বেড়ে যেতে পারে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া এনডিএতে বিমা করপোরেশন আইন সংশোধনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। তবে এই উদ্যোগ এনডিএ হওয়ার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। তাই এনডিএর শর্ত ও সাম্প্রতিক উদ্যোগকে সরাসরি মিলিয়ে দেখা ঠিক হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত:
বাংলাদেশের সাধারণ বীমা করপোরেশনের বাধ্যতামূলক পুনর্বিমা ব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে। পুনর্বিমা হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে বিমা কোম্পানি ঝুঁকি কমাতে নিজের অংশ অন্য সংস্থার কাছে বিক্রি করে।
বিমার ধরন মূলত দুটি—জীবনবিমা ও সাধারণ বিমা। পণ্য, স্থাপনা ও ব্যবসার ঝুঁকি কমাতে সাধারণ বিমা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ বিমা বাধ্যতামূলক, অন্য ক্ষেত্রে তা ঐচ্ছিক। সাধারণ বীমা করপোরেশন ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং এটি বিমা করপোরেশন আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
সরকার বিদ্যমান বিমা করপোরেশন আইন সংশোধন করে “বিমা করপোরেশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” আনার উদ্যোগ নিয়েছে। খসড়া তৈরি ও মতামত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-কে। আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম স্বাক্ষরিত খসড়া ইতিমধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্তকরণের দিকে এগোচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া এনডিএ (অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি বা নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট)-তে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক পুনর্বিমা ব্যবস্থা বাতিল করবে। সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে বিমা কোম্পানিগুলোর ন্যূনতম ৫০ শতাংশ পুনর্বিমা করার বাধ্যবাধকতাও তুলে দেওয়া হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেছেন, “এনডিএতে এই ধারা থাকলেও, এ আইন সংশোধনের উদ্যোগ এনডিএ হওয়ার আগে থেকেই ছিল। তাই এনডিএর শর্ত ও সাম্প্রতিক উদ্যোগকে সরাসরি মিলিয়ে দেখা ঠিক হবে না।”
এনডিএ ২০২৫ সালের ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্কের হার কমানোর আলোচনার অংশ হিসেবে সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। তিন মাস পর জুলাইয়ে তা ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় এবং ১ আগস্ট চূড়ান্তভাবে ২০ শতাংশ করা হয়।
পুনর্বিমা থেকে কত আয়:
সাধারণ বীমা করপোরেশন জানিয়েছে, ২০২৪ সালে সংস্থাটি ১ হাজার ১২২ কোটি টাকা পুনর্বিমা প্রিমিয়াম আয় করেছে। গত পাঁচ বছর ধরে সংস্থাটি গড়ে প্রতিবছর ৪০০ কোটি টাকার কর–পূর্ববর্তী মুনাফা করে আসছে।
করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, এই আয় থেকেই তারা বর্তমান কর্মরতদের বেতন-ভাতা এবং অবসরভোগীদের পেনশন দেয়। তবে পুনর্বিমা বিষয়ক ধারাটি বাতিল হলে সংস্থার আয় ও মুনাফা কমবে। এতে পেনশন চালু রাখতে সরকারের ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। সাধারণ বীমা করপোরেশন আশঙ্কা করছে, ধারাটি বাতিল হলে প্রতিষ্ঠানটি আর স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে তার বর্তমান আর্থিক দায়ভার মেটাতে পারবে না।
আইন সংশোধন:
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, সরকারি সম্পত্তি বা সরকারের দায়-ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের নন-লাইফ বিমা ব্যবসা সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে ১০০ শতাংশ অবলিখন (আন্ডাররাইট) করতে হয়। ব্যবসার ৫০ শতাংশ নিজের কাছে রেখে বাকি ৫০ শতাংশ বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে সমানভাবে ভাগ করতে হয়।
তবে সরকারের প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ায় এই ১০০ শতাংশ অবলিখনের বাধ্যবাধকতা শিথিল করার কথা বলা হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারি কোনো সম্পত্তিতে বিদেশি অর্থায়ন থাকলে সেটির বিমা করবে যে সংস্থা, তার আন্তর্জাতিক মান (রেটিং) থাকতে হবে। এছাড়া, সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ৫০ শতাংশের বেশি মালিকানার ক্ষেত্রকেই সরকারি মালিকানা হিসেবে গণ্য করা হবে।
সাধারণ বীমা করপোরেশন জানিয়েছে, তারা শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। ফলে আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন গ্রাহকরা। এখন পর্যন্ত বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের বিমা ঝুঁকি গ্রহণে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু খসড়ার নিয়ম বাস্তবায়িত হলে বিদেশি অর্থায়নের সব প্রকল্পের বিমা প্রিমিয়াম দেশের বাইরে চলে যাবে। করপোরেশন আরও জানিয়েছে, খসড়া অনুযায়ী ৫০ শতাংশের কম মালিকানা থাকলেই বেসরকারি হিসেবে গণ্য হবে। এর অর্থ, এগুলোর পুনর্বিমা করার কোনো বিধান থাকবে না।
এছাড়া সাধারণ বীমা করপোরেশন এবং বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে পুনর্বিমা প্রিমিয়াম পরিশোধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর কাছে সংস্থার পুনর্বিমা প্রিমিয়াম পাওনা ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। অপরদিকে, কোম্পানিগুলোর দাবি ৯৩০ কোটি টাকা। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী দাবির পরিমাণ ১,৫০০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।
দেশের অন্যতম নন-লাইফ কোম্পানি গ্রিনডেল্টা ইনস্যুরেন্সের উপদেষ্টা তারিক উর রহমান বলেছেন, পুনর্বিমা দাবির টাকা দীর্ঘদিন আটকে রাখা অন্যায়। তিনি বলেন, “আইন সংশোধনের উদ্যোগ স্বাগত। পুনর্বিমা করার সুযোগ উন্মুক্ত করা উচিত। কেউ চাইলে শতভাগ করপোরেশনে করবে, কেউ চাইলে আংশিক বা বিদেশে করবে।”
পুনর্বিমা আইন উন্মুক্ত করার প্রস্তাব:
সরকার পুনর্বিমা (রি-ইনস্যুরেন্স) সংক্রান্ত ধারার আইন সংশোধন ও খসড়া অধ্যাদেশ উন্মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে দেশের বিমা খাত দুর্বল হওয়ায় অভ্যন্তরীণ সতর্কতা দেখা দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, “সরকারি সংস্থার প্রতি গ্রাহকদের আস্থা তুলনামূলক বেশি। দাবি উত্থাপিত হলে বেশির ভাগ বেসরকারি কোম্পানির তা পরিশোধের সক্ষমতা কতটুকু, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। সে কারণে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ হুবহু পাস করা ঠিক হবে না। পুনর্বিমার একাংশ এখনো বাধ্যতামূলক থাকা উচিত। কত শতাংশ, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, কিছু বেসরকারি কোম্পানি শতভাগ পুনর্বিমা সাধারণ বীমা করপোরেশনের সঙ্গে করে, কেউ আবার শতভাগ পুনর্বিমা বিদেশি সংস্থার সঙ্গে করতে চায়। যদি পুনর্বিমার সুযোগ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়, সাধারণ বীমা করপোরেশন আরও সংকটে পড়বে।
মাইন উদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া এনডিএর শর্ত প্রসঙ্গেও বলেন, “এটাই সমস্যা। তবে আমাদের বুঝতে হবে যে দুই দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সমান নয়। আইন সংশোধনের আগে বাংলাদেশকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।”

