বিমা আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও বাংলাদেশে এর বিস্তার এখনও সীমিত। আগে মানুষ ভাবত, বিমা মূলত মৃত্যুর পর সুবিধা পাওয়ার জন্য। অর্থাৎ জীবনের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক তেমন নেই। তবে ধীরে ধীরে সেই ধারণা বদলাচ্ছে। তারপরও বিমা গ্রহীতার সংখ্যা এখনো নগণ্য।
বিমা জীবন এবং সম্পত্তির অনিশ্চয়তা—যেমন দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা ক্ষতির বিরুদ্ধে—আর্থিক সুরক্ষা দেয়। বিশ্বব্যাপী এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশে এখনও এই সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকে দেশে বিমার কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ৮১টি বিমা কোম্পানি কাজ করছে। ৫২ বছর পার হলেও মাত্র ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ সরকারি হিসেবে বিমার আওতায় আছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুশাসনের অভাব, দুর্বল বিনিয়োগ কৌশল, সীমিত পণ্যের বৈচিত্র্য এবং ডিজিটালাইজেশনের অভাব বাংলাদেশের বিমা খাতকে পিছিয়ে রেখেছে। তারা মনে করেন, খাতের উন্নয়নের জন্য সুশাসন, দক্ষ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা এবং গ্রাহকবান্ধব বিমাপণ্য অপরিহার্য। এছাড়া নীতিবান মানবসম্পদ, আইডিআরএর সঠিক নজরদারি ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার সমন্বয় টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
উন্নত দেশে জীবন বিমা ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু বা দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমাতে স্বাস্থ্যবিমাও ব্যাপক প্রচলিত। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও বিমা খাত শক্তিশালীভাবে দাঁড়াতে পারেনি।
বিমা কোম্পানিগুলোর আয় আসে গ্রাহকদের প্রদত্ত প্রিমিয়াম থেকে। সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে ভবিষ্যতে দাবি পরিশোধে সমস্যা হয়। বর্তমানে বেশির ভাগ কোম্পানি তাদের তহবিল ব্যাংক ডিপোজিট, সরকারি বন্ড ও কিছু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
সুশাসনের অভাবের কারণে অনেক কোম্পানি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশে অনিয়ম, প্রিমিয়াম ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব করছে। এতে জনগণের আস্থা কমেছে। বাংলাদেশ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কিছু কোম্পানি গ্রাহকের প্রিমিয়াম সঠিকভাবে বিনিয়োগ না করে অনৈতিকভাবে পরিচালনা করছে। জরিমানা সত্ত্বেও কিছু কোম্পানি এই খাতকে লুটপাটের জন্য বেছে নিচ্ছে।
খাত বিশেষজ্ঞ ও চার্টার্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সের সাবেক সিইও জিয়াউল হক বলেন, “ব্যাংকিং খাত প্রযুক্তিগতভাবে অনেক উন্নত। কোনো ব্যাংক অন্যায় করলে বাংলাদেশ ব্যাংক সঙ্গে সঙ্গে তা চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু বিমা খাত এখনও সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ না হলেও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারছে না।”
জিয়াউল হক আরও বলেন, “বিমা খাত ডিজিটালাইজেশন করলে গ্রাহক প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য জানতে পারবে। এতে বিমার প্রতি আস্থা বাড়বে এবং শৃঙ্খলাও ফিরবে। তবে বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনে ভারত–পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার তুলনায় পিছিয়ে। গত বছর নেপালও আমাদের সমপর্যায়ে উঠে এসেছে।” তিনি যোগ করেন, “অর্থনীতিতে বিমার অবদান বাড়াতে হলে ডিজিটালাইজেশনে গুরুত্ব দিতে হবে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।”
জিডিপিতে কমছে বাংলাদেশের বিমা খাতের অবদান:
বিশ্বের প্রায় সব দেশে জিডিপিতে বিমা খাতের অংশ বেড়ে চলেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারও বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বিমা খাতের অবদান বাড়ার বদলে কমছে।
বর্তমানে জিডিপিতে বিমার অংশ মাত্র ০.৪৫ শতাংশ। দুই বছর আগে এটি প্রায় ১ শতাংশ ছিল। বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনীতিতে বিমার অবদান বাড়াতে হলে ডিজিটালাইজেশন ও দক্ষ জনশক্তির উন্নয়ন জরুরি। সবার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে জনগণের সচেতনতা বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ।
বিমা দাবি পরিশোধে বাড়ছে আস্থাহীনতা:
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সবশেষ অনিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে বিমা দাবি পরিশোধের করুণ চিত্র দেখা গেছে। এই সময়ে সাধারণ বিমা খাতে মোট দাবির মাত্র ৮.৩২ শতাংশই পরিশোধ হয়েছে। অর্থাৎ ৯১.৬৮ শতাংশ দাবি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
জীবন বিমা খাতে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো হলেও, মোট দাবির মাত্র ৩৫ শতাংশই পরিশোধ হয়েছে। অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ ৬৫ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে উভয় খাতে অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ অনেক বেশি। লাখ লাখ গ্রাহক বিমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য কোম্পানিগুলোর দরজায় ঘুরছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আস্থাহীনতার মূল কারণ হলো মেয়াদ শেষে বিমার টাকা যথাসময়ে ফেরত না পাওয়া এবং প্রতারণার শিকার হওয়া। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিমা খাতের বিস্তার কম থাকার অন্যতম কারণও এই আস্থাহীনতা। দীর্ঘদিন ধরে দাবির অনিষ্পত্তি এবং প্রতারণার ইতিহাসের কারণে গ্রাহকের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু অভিযোগ রয়েছে, যে বিমা কোম্পানি বা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে খাতের ওপর জনগণের আস্থা আরও কমছে।
বিমা খাতে প্রিমিয়াম ও সম্পদে মিশ্র প্রবণতা:
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় উপস্থাপিত বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জীবন বিমা খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় সামান্য কমেছে। ২০২৩ সালে এটি ছিল ১১,৫১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা ২০২৪ সালে কমে ১১,৩৮৯ কোটি ৭০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
তবে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে এটি ৩১,৯১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ছিল, ২০২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ৩৩,২৩২ কোটি ২০ লাখ টাকা। বিনিয়োগও বাড়ার দেখা গেছে—২০২৩ সালে ৩৩,৪৬১ কোটি ৩০ লাখ টাকা থেকে ২০২৪ সালে বেড়ে ৩৪,২৯২ কোটি ৯০ লাখ টাকা হয়েছে। কোম্পানিগুলোর মোট সম্পদও ২০২৩ সালের ৪৪,১৪১ কোটি ১০ লাখ টাকা থেকে ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬,০৪৪ কোটি ৩০ লাখ টাকায়।
সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও মিশ্র প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ২০২৩ সালে তাদের সম্পদ ১১,৬৪৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ছিল, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ১১,৯১৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা হয়েছে। তবে বিনিয়োগ সামান্য কমেছে—২০২৩ সালে ৫,৭৭২ কোটি টাকা থেকে ২০২৪ সালে ৫,৬১৪ কোটি টাকায় নেমেছে। প্রিমিয়াম আয় বৃদ্ধি পেয়েছে; ২০২৩ সালে ৪,২৩৫ কোটি ১০ লাখ টাকা থেকে ২০২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ৪,৩৪৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জীবন বিমা খাতে বিনিয়োগ ও সম্পদের ধারাবাহিক বৃদ্ধি কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। তবে সাধারণ বিমা খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং প্রিমিয়াম আয়ের অনিয়মিত বৃদ্ধি খাতের মিশ্র প্রবণতারই পরিচায়ক।
বিমা আইন সংশোধনের আগে আইডিআরএর সংস্কার জরুরি:
বিমা খাতের সংস্কারের কথা বলে বিদ্যমান বিমা আইন, ২০১০-এর সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাতের সংস্কারের আগে দরকার আইডিআরএর নিজস্ব সংস্কার।
তারা মনে করেন, বাংলাদেশে বিমা খাত অনুন্নত ও অবহেলিত। জনগণের সচেতনতা কম এবং বিমার যথাযথ জ্ঞান নেই। তাই শুধুমাত্র আইন সংশোধন নয়, খাতের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নও জরুরি। কিন্তু প্রস্তাবিত আইন সংশোধনে এই উন্নয়নের দিকটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
গত বছর জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরও আইডিআরএ বিমা খাত সংস্কারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। জীবনবিমা খাতের কিছু কোম্পানির তহবিল তছরুপ হওয়া, গ্রাহকের বকেয়া দাবি পরিশোধ এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নন-লাইফ বিমা খাতেও অবৈধ কমিশন বন্ধ ও দক্ষ জনবল তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ এখনো চলছে প্রেষণে আসা সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে, যাদের অধিকাংশের বিমাবিষয়ক অভিজ্ঞতা নেই। ফলে, আইন সংশোধনের আগে বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা দরকার যে, বর্তমান আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না।
বিমা খাতে গ্রাহকের আস্থা ও আধুনিক বিক্রির চ্যালেঞ্জ:
প্রতিবছর নতুন পলিসির তুলনায় আরও বেশি পলিসি বাতিল হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের আগে পলিসি বাতিল হলে বিমা কোম্পানি সেই টাকা পেয়ে যায়। ফলে কোম্পানিগুলোও বাতিল ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে বড় সংখ্যায় পলিসি বাতিল হচ্ছে প্রতিবছর। এছাড়া বিমার সুবিধা, পলিসি বাতিলের শর্ত ও সময় সম্পর্কে কোম্পানির এজেন্টরা গ্রাহকদের প্রায়ই সম্পূর্ণ তথ্য দেন না। ফলে গ্রাহক বিমা সম্পর্কে যথাযথ সচেতন হয় না।
আধুনিক পদ্ধতিতে বিমা বিক্রি:
আইডিআরএ বর্তমানে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম বা ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু করেছে। এতে প্রতিটি কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহ, দাবি নিষ্পত্তি ও বিনিয়োগ কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করা যায়। আশা করা হচ্ছে, এতে অনিয়ম কমবে এবং স্বচ্ছতা বাড়বে।
ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে বিমা বিক্রি হয় ব্যাংকের শাখাগুলোর মাধ্যমে। ব্যাংক তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং গ্রাহকের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে জীবনবিমা ও সাধারণ বিমা–উভয় ধরনের পলিসি বিক্রি করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই চ্যানেলের মূল সুবিধা হলো বিপণন ব্যয় কমে যাওয়া। প্রথাগতভাবে দ্বারপালক এজেন্ট ব্যবস্থার তুলনায় ব্যাংকাস্যুরেন্সে গ্রাহকের সুবিধা বেশি এবং আস্থা বাড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ব্যাংক এবং বিমা কোম্পানি যৌথভাবে ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা দিচ্ছে। এতে দেশের মোট জাতীয় আয়ে বিমার অবদান বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে এখনও সাধারণ মানুষের বিমা সচেতনতা কম। অনেকেই মনে করেন, বিমা মানেই ঝামেলা বা অর্থের অপচয়। তবে একটি ভালো বিমা পণ্য বাস্তবে জনগণের আর্থিক সুরক্ষার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুশাসন নিশ্চিত করা, পেশাদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করা এবং গ্রাহককেন্দ্রিক বিমা পণ্য বাজারে আনা গেলে, বিমা খাত শুধু ব্যক্তির আর্থিক নিরাপত্তাই দেবে না, বরং দেশের জাতীয় উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।

