১৯৭১ সালের (২ ডিসেম্বর) আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। একটি অঞ্চল, যা দীর্ঘকাল ধরে ব্রিটিশ প্রটেক্টরেটের অধীনে ছিল এবং যার অর্থনীতি মুক্তো সংগ্রহ ও মাছ ধরার মতো ঐতিহ্যবাহী পেশার উপর নির্ভরশীল ছিল। হঠাৎই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়- সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।
মাত্র সাতটি আমিরাতের একটি ছোট্ট ফেডারেশন আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থান দখল করে আছে। আধুনিক অবকাঠামো, বৈচিত্র্যময় অর্থনীতি, উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা- এই সব কিছুর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম, কৌশলী নেতৃত্ব এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
১৮২০ সাল থেকে শুরু করে উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত আরব উপসাগরের উপকূলবর্তী কিছু ছোট ছোট রাজ্য ব্রিটিশদের সঙ্গে একাধিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই অঞ্চলগুলো ‘ট্রুশিয়াল স্টেটস’ নামে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ সরকার মূলত ভারতের মতো উপনিবেশ এবং বাণিজ্যপথ রক্ষার স্বার্থে এই অঞ্চলকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে এই রাজ্যগুলো ব্রিটিশ স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের শাসন চালায়।

বিশ্বযুদ্ধ ও উপনিবেশিক অর্থনীতির বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশদের প্রভাব কমতে থাকে। অবশেষে ১৯৬৮ সালে যুক্তরাজ্য ঘোষণা করে যে তারা ১৯৭১ সালের মধ্যে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করবে।
এই ঘোষণার পর- উপসাগরীয় ছোট ছোট শেখডমগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার পথ খুঁজতে থাকে। বাহরাইন ও কাতার পৃথকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু বাকি আমিরাতগুলো একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী ফেডারেশন গঠনের উদ্যোগ নেয়।
আবুধাবির তৎকালীন শাসক শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ রশিদ বিন সাঈদ আল মাকতুম নেতৃত্ব দেন ঐক্যের প্রক্রিয়াকে। ‘ইউনিয়ন অ্যাকর্ড’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে ছয়টি আমিরাত- আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ, আজমান, ফুজাইরাহ এবং উম্ম আল-কুওয়াইন- একত্রিত হয় ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সপ্তম আমিরাত রাস আল-খাইমাহ এই ফেডারেশনে যোগ দেয়।
শেখ জায়েদ হন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন প্রজ্ঞাবান, প্রগতিশীল এবং কৌশলী নেতা হিসেবে দেশের ভিত শক্ত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে কার্যকরী ভূমিকা রাখেন।

স্বাধীনতার পরপরই সংযুক্ত আরব আমিরাত আরব লীগ ও জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৮১ সালে আবুধাবিতে প্রথমবারের মতো গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (GCC) এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ইউএই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক এবং কৌশলগত রাজনীতিতে দেশের গুরুত্ব বাড়ে।
প্রাথমিক বছরে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশাল বিনিয়োগ করা হয়। ১৯৭৩ সালে চালু হয় ইউএই দিরহাম। একই বছর প্রথম ট্রাফিক লাইট বসানো হয় আবুধাবিতে। ১৯৭৫ সালে বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করে, ইউএই-এর মাথাপিছু গড় আয় বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৭৭ সালে শারজাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উদ্বোধন করা হয়।
১৯৭৫ সালের শেষ নাগাদ দেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৬.৫ লাখের মতো। ১৯৭৬ সালে ইউএই তার সাতটি আমিরাতের পৃথক সামরিক বাহিনী একত্রিত করে একটি ফেডারেল সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। এটি ছিল রাষ্ট্র হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

১৯৫০-এর দশকে আবুধাবির উপকূলে তেল আবিষ্কার হয়। এরপর দেশটির ভাগ্যবদল শুরু হয়। ইউএই এখন বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের অধিকারী। তবে শুধু তেলের উপর নির্ভর না করে ইউএই অর্থনীতির বহুমুখীকরণ শুরু করে।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা ও তেলের দামের অস্থিরতা দেশটিকে সচেতন করে তোলে। তাই পর্যটন, নির্মাণ, ব্যাংকিং, লজিস্টিকস, মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু হয়। এই কৌশল দেশটিকে একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
দুবাই ও আবুধাবি আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বস্বীকৃত। এমিরেটস এয়ারলাইন, দুবাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের সাথে সংযুক্তি- এই সবই ইউএই-এর রূপান্তরের প্রমাণ।

ইউএই একদিকে যেমন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং পর্যটন বিনোদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে অগ্রগামী, অন্যদিকে দেশটি একটি ইসলামিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলে।
আইন অনুযায়ী ধর্মত্যাগ, সমকামিতা, জনসমক্ষে চুম্বন কিংবা অ্যালকোহল সেবনের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আছে। ভিসার নিয়ম-কানুন কঠোর। শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে সমালোচনা থাকলেও দেশটি বহুজাতিক অভিবাসী জনগণের সহাবস্থানে একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ তৈরি করেছে।
জাতিসংঘের মতে, ইউএই-তে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অভিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। এক জরিপে দেখা যায়, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ শতাংশই বিদেশি। এই বৈচিত্র্য দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড গঠন করেছে।
ইউএই কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ এবং প্রতিবেশী উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে এর সুসম্পর্ক রয়েছে। দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলোচিত হয়েছে (আব্রাহাম চুক্তি)।
তবে একই সঙ্গে ইউএই ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ভূমিকা রাখার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছে।
১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো নারী শিক্ষার্থীদের ইউএই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে নারীরা শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এমিরাতি নারীরা সরকারি খাতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন এবং উদ্যোক্তা হিসেবেও সাফল্য পাচ্ছেন।

প্রতিবছর ২ ডিসেম্বর ‘জাতীয় দিবস’ পালিত হয় অত্যন্ত ধুমধামভাবে। এই দিনটিকে ঘিরে সাতটি আমিরাতেই আতশবাজি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্ট এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাকে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু আমিরাতিরা নয়, প্রবাসীরাও অংশ নেন এই উৎসবে। বুলগেরিয়ার পাহাড় থেকে শুরু করে দুবাইয়ের মেট্রোপলিটনে পর্যন্ত এই উৎসব ছড়িয়ে পড়ে।
মাত্র ৫৩ বছরের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের ধনী, উন্নত এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। এর পেছনে রয়েছে কার্যকর নেতৃত্ব, তেল সম্পদের সুচিন্তিত ব্যবহার, কূটনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের ভারসাম্য রক্ষা।

তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি রয়েছে কিছু প্রশ্নও- মানবাধিকার, রাজনৈতিক মুক্তি, শ্রমিক অধিকার এবং গণতন্ত্র। দেশটির ভবিষ্যত অনেকাংশে নির্ভর করছে তার সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার মাঝে একটি ভারসাম্য রক্ষার উপর।
তবুও- অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৭১ সালের বালির টিবির উপর দাঁড়ানো ট্রুশিয়াল স্টেটসের সেই ছোট্ট ফেডারেশন আজ বিশ্বমানচিত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত নামক এক উজ্জ্বল চিহ্ন হয়ে উঠেছে।

