রডিনস্কে শহরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই গায়ে লাগে একধরনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। কিছুক্ষণ পরেই দেখা মেলে তার উৎসের—একটি ২৫০ কেজি ওজনের ‘গ্লাইড বোম্ব’ আঘাত হেনেছে শহরের প্রধান প্রশাসনিক ভবনে। সঙ্গে ধসে পড়েছে তিনটি আবাসিক ভবন। আমরা সেখানে পৌঁছেছি বোমা বিস্ফোরণের একদিন পর কিন্তু ধ্বংসস্তূপের কিছু অংশ এখনো জ্বলছে। সূত্র: বিবিসি
শহরের প্রান্তে শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ—ইউক্রেনীয় সেনারা ড্রোন ভূপাতিত করছে। রডিনস্কে শহরটি পোক্রোভস্ক থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে। গত বছর শরৎকাল থেকে রাশিয়া দক্ষিণ দিক থেকে এই শহরটি দখলের চেষ্টা করছে, কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনী এখনো রাশিয়ান সেনাদের থামিয়ে রেখেছে।

কিন্তু রাশিয়া কৌশল বদলেছে। এখন তারা সরাসরি আক্রমণের বদলে ঘিরে ফেলার পন্থা নিয়েছে—সরবরাহ পথ কেটে দিতে চাইছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে, যখন কূটনৈতিকভাবে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, রাশিয়া তাদের আক্রমণের তীব্রতা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের পর এটিই তাদের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি।
এই অগ্রগতির প্রমাণ মিলছে রডিনস্কেতে।
আমরা শহরে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথার ওপর দেখা যায় একটি রুশ ড্রোন। আমাদের টিম দৌড়ে আশ্রয় নেয় কাছের একটি গাছের আড়ালে। গায়ে ঠেসে দাঁড়াই, যাতে ড্রোনটি আমাদের না দেখতে পায়। হঠাৎ এক বিকট বিস্ফোরণের শব্দ—কাছে কোথাও একটি দ্বিতীয় ড্রোন বিস্ফোরিত হয়েছে। প্রথম ড্রোনটি তখনো মাথার ওপর ঘুরছে। তার ভোঁ ভোঁ শব্দ ভয় ধরিয়ে দেয়।
যখন আর ড্রোনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল না, তখন আমরা দৌড়ে পাশের একটি পরিত্যক্ত ভবনে আশ্রয় নিই। কয়েক মিনিট পর সেই ড্রোনের শব্দ আবার শুনি—সম্ভবত আমাদের চলাফেরা দেখে ফিরে এসেছে।
রডিনস্কেতে ড্রোনের এমন আধিক্য প্রমাণ করে যে আক্রমণ আসছে আগের চেয়ে অনেক কাছে থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, পোক্রোভস্ক থেকে কস্তান্তিনিভকা পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে নবদখলকৃত এলাকাগুলো থেকে এসব ড্রোন ছাড়া হচ্ছে।
আধাঘণ্টা পর, যখন আর কোনো ড্রোনের শব্দ শুনতে পাই না, দ্রুত গাছের ছায়ায় রাখা গাড়ির দিকে ছুটি এবং রডিনস্কে থেকে বেরিয়ে পড়ি। হাইওয়ের পাশে দেখি ধোঁয়া উড়ছে, কিছু একটা পুড়ছে—সম্ভবত ভূপাতিত একটি ড্রোন।
আমরা এগিয়ে যাই বিলিৎসকে শহরের দিকে, যেটি কিছুটা নিরাপদ। সেখানে দেখি একটি পাড়ার ঘরগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। রাতে মিসাইল হামলায় ধ্বংস হয়েছে। এই বাড়িগুলোর একটিই ছিল ৬১ বছর বয়সী সভেতলানার।

“আগে দূরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যেত, এখন আমাদের শহরেই হামলা হচ্ছে,” বলেন সভেতলানা, ধ্বংসস্তূপ থেকে তার কিছু জিনিসপত্র তুলে নিতে নিতে। ভাগ্য ভালো, হামলার সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না।
“আপনি শহরের কেন্দ্রে গেলে দেখবেন কত কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে—বেকারি, চিড়িয়াখানা, সব শেষ,” তিনি বলেন।
ড্রোনের নাগালের বাইরে একটি সেফ হাউসে আমরা দেখা করি ইউক্রেনের ৫ম অ্যাসল্ট ব্রিগেডের একটি কামান ইউনিটের সৈন্যদের সঙ্গে।
“রুশ আক্রমণের তীব্রতা এখন অনেক বেশি। রকেট, মর্টার, ড্রোন—যা কিছু আছে সব ব্যবহার করছে তারা সরবরাহ পথ কেটে দিতে,” বলেন সেরহি নামের এক সেনা।
তাদের ইউনিট তিন দিন ধরে অপেক্ষা করছে – মেঘলা আকাশ কিংবা ঝড়ো বাতাসের জন্য, যাতে ড্রোন থেকে কিছুটা সুরক্ষা পাওয়া যায়।
এই চলমান সংঘাতে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি বদলাচ্ছে, আর সেনাদের প্রতিক্রিয়াও বদলাতে হচ্ছে। সর্বশেষ হুমকির নাম—ফাইবার অপটিক ড্রোন। এই ড্রোনের সঙ্গে যুক্ত থাকে কয়েক কিলোমিটার লম্বা তার, যা নিয়ন্ত্রণকারী সেনার ডিভাইসের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এর ফলে ভিডিও ও নিয়ন্ত্রণ সংকেত কোনো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে নয়, সরাসরি তার দিয়ে আদানপ্রদান হয়—যার ফলে এটি ইলেকট্রনিক জ্যামিং দিয়ে বন্ধ করা যায় না।
“রাশিয়া অনেক আগেই এই ড্রোন ব্যবহার শুরু করেছে। আমরা তখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে ছিলাম,” বলেন ‘ভেনিয়া’, ইউক্রেনের ৬৮তম জ্যাগার ব্রিগেডের একজন ড্রোন চালক।
“এমনকি বাড়ির ভেতরেও ঢুকে লক্ষ্য খোঁজা যায় এসব ড্রোন দিয়ে।”
“আমরা ঠাট্টা করে বলি, স্কিসর নিয়ে যাওয়া উচিত, যেন তার কেটে ফেলা যায়,” বলেন সেরহি।
এই ড্রোনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও—যেমন গতি কম, কিংবা গাছে জড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি—তবুও রাশিয়ার এই ব্যাপক ব্যবহার ইউক্রেনীয় সেনাদের জন্য পথ চলাকেই আরও ভয়ংকর করে তুলেছে।
৫ম অ্যাসল্ট ব্রিগেডের রিকন ইউনিটের প্রধান সার্জেন্ট ওলেস বলেন, “আপনি যখন কোনো অবস্থানে ঢুকবেন, আপনি জানবেন না আপনাকে দেখা হয়েছে কিনা। আর যদি দেখা হয়ে যায়, তাহলে হয়ত এটাই আপনার জীবনের শেষ কিছু মুহূর্ত।”
এই ভয়ই সেনাদের সেই অবস্থানে দীর্ঘ সময় কাটাতে বাধ্য করছে।
ওলেস এবং তার সহযোদ্ধা ম্যাকসিম এক গ্রামীণ বাড়িকে অস্থায়ী ঘাঁটিতে রূপান্তরিত করেছেন, যেখানে তারা ডিউটির ফাঁকে কিছুটা বিশ্রাম নেন। এই ধরনের ফ্রন্টলাইনে এখন সাংবাদিকরা খুব কমই যান—ঝুঁকি অনেক বেশি।
ম্যাকসিম বলেন, “আমি একবার একটানা ৩১ দিন ছিলাম অবস্থানে। তবে আমি এমন অনেকজনকে চিনি যারা ৯০ বা ১২০ দিনও থেকেছে। আগে ড্রোন ছিল না, তখন ৩ থেকে ৭ দিনের রোটেশন হতো।”
“যুদ্ধ মানে রক্ত, মৃত্যু, কাদা আর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। এমনই দিন কাটে প্রতিদিন। একবার তিনদিন আমরা ঘুমাইনি—প্রতি মুহূর্তে সতর্ক। রাশিয়ানরা ঢেউয়ের পর ঢেউ আক্রমণ করেছিল। সামান্য ঢিলেও আমাদের মরতে হতো।”
ওলেস বলছেন, রুশ পদাতিক বাহিনীও এখন কৌশল বদলেছে। আগে তারা দলে করে আক্রমণ করত, এখন কখনো একজন বা দু’জন করে আসে। কখনো মোটরসাইকেল বা কোয়াডবাইক ব্যবহার করে ঢুকে পড়ে। ফলে ফ্রন্টলাইন আর আগের মতো সুস্পষ্ট নয়, বরং দাবার ছকের মতো—পজিশনগুলো জটিলভাবে মিশে গেছে।

এই জটিল বাস্তবতায় একদিকে রাশিয়ার সাম্প্রতিক কিছু অগ্রগতি থাকলেও, পুরো দোনেৎস্ক অঞ্চল দখল করা তাদের জন্য সহজ হবে না।
ইউক্রেন শক্তভাবে প্রতিরোধ করছে, তবে তাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি। যুদ্ধ চতুর্থ গ্রীষ্মে গড়িয়েছে, আর ইউক্রেনের জনবল ঘাটতিও এখন বেশ স্পষ্ট।
আমরা যেসব সেনার সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের প্রায় সবাই যুদ্ধ শুরুর পর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। হাতে গোনা কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ, বাকিটা শিখতে হয়েছে বাস্তব যুদ্ধের মধ্যে থেকেই।
ম্যাকসিম আগে একটি পানীয় কোম্পানিতে কাজ করতেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম—তাঁর পরিবার কেমন করে সহ্য করছে?
“কঠিন… খুব কঠিন। আমার পরিবার আমাকে খুব সাপোর্ট করে। কিন্তু আমার একটা দুই বছরের ছেলে আছে। ওকে আমি খুব একটা দেখতে পাই না। মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয়। যতটা সম্ভব, ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করি,”—বলতে বলতেই তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে।
সে একজন সৈনিক—তার দেশকে রক্ষা করছে। কিন্তু সে একইসঙ্গে একজন বাবা—যে শুধু তার ছোট ছেলেকে খুব মিস করছে।

