দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও- এবার নতুন করে পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তি, যা দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগির ভিত্তি হিসেবে কাজ করছিল, তা ভারতের একতরফা স্থগিত করার সিদ্ধান্তে নতুন সংকটের সূচনা হয়েছে। এই চুক্তি স্থগিতের পেছনে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ এবং দীর্ঘদিনের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা কাজ করছে।
সিন্ধু নদী, যার উৎপত্তি তিব্বতের মানসরোবর হ্রদের কাছে এবং যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে মিশেছে, দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎস। ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি প্রধান নদী- ইরাবতী (রাভি), বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সুতলেজ), সিন্ধু, ঝিলাম এবং চেনাব- এর পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা হয়। পূর্বাঞ্চলের তিনটি নদী (ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু) ভারতের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদী (সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব) এর প্রায় ৮০% পানি পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ এবং অসংখ্য সংঘাত সত্ত্বেও টিকে ছিল- যা আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
২০২৫ সালের এপ্রিলে কাশ্মীরের ভারত-নিয়ন্ত্রিত পহেলগামে একটি সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তোলে। হামলার দায় স্বীকার করে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ), যার সঙ্গে পাকিস্তান-ভিত্তিক লশকর-ই-তাইয়েবার যোগসূত্র রয়েছে বলে ভারত দাবি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে এবং পাকিস্তানে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের হুমকি দেয়।
মে মাসে ভারত চেনাব নদীর উপর বাগলিহার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের গেট বন্ধ করে পানি প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং পরে সালাল বাঁধের গেট খুলে পাকিস্তানে বন্যার আশঙ্কা তৈরি করে। পাকিস্তান এই পদক্ষেপকে “যুদ্ধের ঘোষণা” হিসেবে অভিহিত করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। পাকিস্তানের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি উসমান জাদুন জাতিসংঘে বলেন, “ভারত নদীর পানিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে- যা ইসলামাবাদ কখনোই মেনে নেবে না।”

বিরোধের কারণ-
সিন্ধু পানি বিরোধের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:
-
জলবায়ু পরিবর্তন: হিমালয়ের হিমবাহ গলনের ফলে সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলোর পানির প্রবাহ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় পাকিস্তানের কৃষি ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
-
ভারতের অবকাঠামো উন্নয়ন: কাশ্মীরে কিশাণগঙ্গা, বাগলিহার এবং রাটল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো ভারতের বাঁধ নির্মাণ পাকিস্তানের পানি প্রবাহে প্রভাব ফেলছে। পাকিস্তানের দাবি, এই প্রকল্পগুলো চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করছে।
-
রাজনৈতিক উত্তেজনা: পহেলগাম হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দেন, “রক্ত আর পানি একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না।” এটি কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনার প্রতিফলন।
-
অর্থনৈতিক নির্ভরতা: পাকিস্তানের কৃষিখাতের ৮০% এবং জলবিদ্যুতের এক-তৃতীয়াংশ সিন্ধু অববাহিকার পানির উপর নির্ভরশীল। পানি প্রবাহ হ্রাস পেলে দেশটির অর্থনীতি ও জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
দুই পক্ষের প্রতিক্রিয়া-
-
ভারতের পদক্ষেপ: ভারত কাশ্মীরে নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে এবং বাঁধের গেট খোলা-বন্ধের মাধ্যমে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এটিকে অনেকে পানিকে “অস্ত্র” হিসেবে ব্যবহারের কৌশল হিসেবে দেখছেন।
-
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া: পাকিস্তান বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশটি দ্রুত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পন্ন করে পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করছে। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা ভারতের পদক্ষেপকে “যুদ্ধের ঘোষণা” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
-
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তারা সরাসরি সালিশি করবে না, তবে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারে। পাকিস্তান দ্য হেগ-এর পারমানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন বা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছে।
-
জনমত: এক্স-এ পোস্টগুলোতে দেখা যায়, ভারতের কিছু ব্যবহারকারী এই পদক্ষেপকে “পানির আঘাত” হিসেবে সমর্থন করছেন, যেখানে পাকিস্তানের ব্যবহারকারীরা এটিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে পানি প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে শুষ্ক মৌসুমে এর প্রভাব পড়তে পারে। পাকিস্তানের প্রধান উদ্বেগ হলো ভারতের তথ্য প্রদান বন্ধ করা। পাকিস্তানের সাবেক কমিশনার শিরাজ মেমন জানিয়েছেন, ভারত আগে থেকেই মাত্র ৪০% তথ্য সরবরাহ করছিল, যা ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাসে ব্যর্থতার কারণ ছিল। এই তথ্য ঘাটতি পাকিস্তানের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও সেচ পরিকল্পনাকে আরও জটিল করে তুলছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাচ্ছেন, বিশেষ করে তার হিন্দুত্ববাদী সমর্থকদের মধ্যে। তিনি বলেছেন, “আমরা চুক্তি স্থগিত করেছি, আর তারা ঘামতে শুরু করেছে।” ভারতের জন্য পানির চাহিদা বাড়ছে, কারণ দেশটির ১৪০ কোটি জনসংখ্যার জন্য মাত্র ৪% জলসম্পদ রয়েছে। সিন্ধু অববাহিকার পানি কাশ্মীরে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিন্ধু পানি চুক্তির স্থগিতকরণ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে একটি নতুন সংকটের সূচনা করেছে। এই বিরোধ কেবল পানি বণ্টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত টেকসইতার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। পাকিস্তানের জন্য পানি জীবন-মরণের বিষয়, আর ভারতের জন্য এটি কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। এই সংকট নিরসনে দুই দেশের সহযোগিতা, বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন জরুরি। পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের পরিবর্তে, টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উভয় দেশই উপকৃত হতে পারে।

