বিশ্বব্যাপী শক্তি সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে সাম্প্রতিক অবৈধ বোমা হামলা বিশ্ব রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। বৃহত্তর পরিকল্পনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের চেয়ে চীনের প্রতি কম মনোযোগ দিচ্ছে, কারণ বৈশ্বিক শক্তি ও প্রভাবের দিক থেকে চীন অনেকখানি এগিয়ে গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ভাবে তারা চীন বা রাশিয়াকে আঞ্চলিক বা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধে প্রলুব্ধ করতে পারবে, তাহলে তারা ব্যর্থ হবে। চীনের যুদ্ধ চালানোর কোনো আগ্রহ নেই; তারা রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যস্ত। এই কারণে বলা যায়, চীন ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ জয় করেছে।
ওসিরাক বিকল্প-
২০০৯ সালের জুনে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট মার্কিন প্রশাসনকে ‘ওসিরাক বিকল্প’ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। ওসিরাক বিকল্পের নাম এসেছে ১৯৮১ সালের ইসরায়েলি আকস্মিক বিমান হামলা থেকে, যেখানে বাগদাদে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করা হয়।
এই বিকল্প বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ এটি মার্কিন স্বার্থের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। স্থলসেনা মোতায়েন করলে ইরাক ও আফগানিস্তানের দীর্ঘ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ত। ইসরায়েলও স্থল আক্রমণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে যোগ দিতে হতো।
বিশ্লেষণটি জানায়, ওসিরাক স্টাইলে আক্রমণ ‘শাসন পরিবর্তন’ কৌশল নয়, যদিও ট্রাম্পের কিছু বক্তব্য ভিন্ন ছিল। তিনি ইরানের শাসন পরিবর্তনের কথা বলেছেন।
যুদ্ধ হলো রাজনীতির অন্য রূপ। যদিও কেউ বলছেন যুদ্ধে কোনও বিজয়ী হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যুদ্ধে জয়লাভ নয় বরং শত্রু দুর্বল করা, জনগণ বিভক্ত করা এবং সম্পদ লুণ্ঠন করা। যখন স্বাভাবিক পথে স্বার্থ সুরক্ষিত না হয়, তখন কিনতে বা আক্রমণ চালাতে হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার বাস্তব উদাহরণ আফ্রিকার ডিআরসি ও রুয়ান্ডার সাম্প্রতিক ‘শান্তি চুক্তি’।
ইরানে বোমা হামলা জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করেছে। এই হামলা কোনো আন্তর্জাতিক অনুমোদন ছাড়াই চালানো হয়, যা ইরানের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বারবার নিশ্চিত করেছে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না।
ভূ-রাজনৈতিক ‘সিংহাসনের খেলা’-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা হলো বহুমেরু বিশ্বে চীনের পুনরায় উত্থান। ট্রাম্প এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়েন চীনকে ‘শতাব্দীর হুমকি’ বলে উল্লেখ করেছেন।
বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে মার্কিন পতন এবং চীনের আধিপত্য বৃদ্ধিই প্রধান বিষয়। মার্কিন অভিজাতদের এখনো সুসংগত কৌশলগত প্রতিক্রিয়া নেই।
চীন জানে তারা এগিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানে পিছিয়ে। হেনরি কিসিঞ্জার পরামর্শ দিয়েছেন মার্কিন-চীন সম্পর্ক বিপর্যয় এড়াতে পারস্পরিক লাভজনক হতে হবে।
চীন দীর্ঘমেয়াদী ‘সিংহাসনের খেলা’ খেলছে। দক্ষিণ-পূর্ব চীন সাগর, তাইওয়ান বা ইরানের উত্তেজনা যাই হোক, তারা যুদ্ধ এড়াতে চায়।
আফ্রিকা ও বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের পথ-
আফ্রিকা ও বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের দেশগুলোকে কৌশলগত ও ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অবস্থান গঠন করতে হবে। বড় কোনো যুদ্ধ হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার নীতি প্রায় একই রকম।
ছোট দেশগুলোকে এখন শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, কারণ বহুমেরু বিশ্বে তাদের হার-জয়ের অনেক কিছু নির্ধারিত হবে। একমেরু বা দ্বিমেরু থেকে বহুমেরু রাষ্ট্র হিসেবে তারা সুবিধা নিতে পারবে।