ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ভারত। এর অংশ হিসেবে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্যের আমদানি বাড়ানোর কথা ভাবছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন হঠাৎ করেই ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ায় নয়াদিল্লি তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইছে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য আলোচনার সঙ্গে যুক্ত ভারতের কর্মকর্তারা।
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের আচরণে তারা বিস্মিত ও হতাশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং পারস্পরিক বাণিজ্য সম্পর্ককে ভারসাম্যপূর্ণ করার চেষ্টা করা।
এক সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস, যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং সোনা আমদানি বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে। এতে আগামী কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে দেশটি বর্তমানে কোনো নতুন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার পরিকল্পনায় নেই।

নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির জবাবে কোনো তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়ার ইচ্ছা ভারতের নেই। তবে তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ফোরামে নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ করেছে, যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত ও গাড়ির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে পাল্টা জবাব দেওয়া যায়।
ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল সম্প্রতি পার্লামেন্টে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব আমরা মূল্যায়ন করছি। রপ্তানিকারক ও শিল্পখাতের সঙ্গে পরামর্শ চলছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট অবশ্য ভারতের প্রতিই আঙুল তুলেছেন। সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘ভারতের কারণেই বাণিজ্য আলোচনা ধীরগতিতে এগোচ্ছে। আমাদের পুরো বাণিজ্য দল এই বিষয়ে হতাশ। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব ভারতের।’
ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ভারতের শুল্কহার খুব বেশি এবং বাণিজ্য বাধাগুলো ‘কঠিন ও বিরক্তিকর’। একইসঙ্গে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত জ্বালানি ও অস্ত্র কেনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ট্রাম্প বলেন, দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে এবং সপ্তাহের শেষ নাগাদ সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু পরে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি মন্তব্য করেন, ‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, আমি কেয়ার করি না।’ তিনি ভারত ও রাশিয়াকে ‘মৃত অর্থনীতি‘ বলেও অভিহিত করেন।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। ট্রাম্পের চোখে এই ঘাটতির কারণেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ১১তম ঘাটতির দেশ। এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১২ হাজার ১০০ কোটি ডলার, যে কারণে এ মাসের শুরুতে ট্রাম্প ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করেন।

বাণিজ্য আলোচনায় ভারতকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে বলেই মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। ভারতও জানিয়ে দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনায় আগ্রহী নয়। ফেব্রুয়ারিতে মোদি যখন হোয়াইট হাউসে সফরে যান, তখন ট্রাম্প এই যুদ্ধবিমান বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা নিজ দেশে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং যৌথভাবে সরঞ্জাম নির্মাণে বেশি আগ্রহী।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও মনোভাব দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। অতীতে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তার চাপে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত থেমে যায়- যা ভারত অস্বীকার করে আসছে। এই ধরনের মন্তব্য ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ককে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে, চলতি বছর ভারত কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার নেতাদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। মোদির আমন্ত্রণে ট্রাম্পের ভারত সফর সেই সময়ই হতে পারে, যদিও এখন তা অনিশ্চয়তার মুখে।

ভারতের সাবেক বাণিজ্যসচিব অজয় দুয়া বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি কিনতে পারবে না। একইভাবে, ভারতীয় বিনিয়োগও যুক্তরাষ্ট্রে আশানুরূপ নয়। তাই আলোচনায় নমনীয়তা দেখানো ছাড়া বিকল্প নেই।
বাজারেও এর কিছু প্রভাব দেখা যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের রুপি সর্বোচ্চ ০.৪ শতাংশ পড়ে যায়, পরে তা কিছুটা পুনরুদ্ধার করে। এনএসই নিফটি ৫০ সূচকও ০.৫ শতাংশ কমেছে।
সব মিলিয়ে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে চাইলেও প্রতিরক্ষা খাতে ট্রাম্পের প্রত্যাশা পূরণ করার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। বরং ভারত এখন এমন একটি বাণিজ্য চুক্তির দিকেই অগ্রসর হচ্ছে, যা উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে এবং যার মাধ্যমে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা যাবে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ট্রাম্পের পরবর্তী সিদ্ধান্ত ও ভারতের পাল্টা কূটনৈতিক কৌশলের ওপর।

